পুলিশ ধরে শিবির, ছাড়ানোর তদবির আওয়ামী লীগের

হরতাল-অবরোধে নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে পুলিশ বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করলেও তাদের ছাড়াতে আওয়ামী লীগ নেতারা তদবির করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে সরকারকে প্রতিবেদন দাখিল করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।

গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনটি সম্প্রতি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের আন্দোলনের নামে যারা সহিংসতা করছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত তিন মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে ৩৮৬টি। এ সব মামলায় অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার জনকে। গ্রেফতারের তালিকায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্য অনুসারে জানা যায়, কিছু কিছু জেলার আওয়ামী লীগ নেতারা গ্রেফতার হওয়া জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য থানার ওসিকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।

শিবিরকর্মী ছাড়ানোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের এক নেতা সম্পর্কে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩১ জানুয়ারি রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানার লোকনাথ স্কুলের সামনের রাস্তায় ছাত্রশিবির ককটেল বিস্ফোরণসহ ত্রাস সৃষ্টি করে। এ সময় হরতাল সমর্থনের একটি মিছিল থেকে শিবিরকর্মী নাওশাদকে (১৯) আটক করে পুলিশ। তিনি নওগাঁ জেলার মান্দা থানার বদ্দপুর গ্রামের মো. শওকতের ছেলে। আটক করার পর তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

এ ঘটনায় দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আওয়ামী লীগের এক কর্মী বোয়ালিয়া থানায় এসে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেনকে বলেন, ‘রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক ডাবলু সরকার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি আপনাকে তার অফিসে যেতে বলেছেন।’

দলীয় অফিসে ৩০-৩৫ জনের সামনে ওসিকে আওয়ামী লীগের সম্পাদকের হুমকির প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খবর পেয়ে ওসি রাজশাহী মহানগর সম্পাদক ডাবলু সরকারের অফিসে যান। এ সময় সেখানে মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ ও সহ-সভাপতি ইকবালসহ ৩০-৩৫ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সবার উদ্দেশে ওসি সালাম দিতেই ডাবলু সরকার ওসিকে বলেন, ‘আপনারা কী পেয়েছেন? যাকে তাকে আমার কথা ছাড়া ধরপাকড় করছেন। লাখ লাখ টাকা ঘুষ খাচ্ছেন। শত শত মানুষ ধরছেন আর টাকা নিয়ে ছাড়ছেন। আমি যাকে ছাড়তে বলি ছাড়ছেন না। আমি যাকে ধরতে বলি তাকেও ধরেন না। প্রতিটি লোক ধরার আগে আমাকে জানাচ্ছেন না।’

আওয়ামী লীগের ওই নেতা আরও বলেন, ‘আমি দলের জেনারেল সেক্রেটারি, এখন থেকে আমার সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কোনো লোক ধরবেন না। আপনার এসিকে (সহকারী কমিশনার) বলে দেবেন, আমরা অনেক এসি পার করছি এরকম এসি পাইনি। এখন থেকে আমার কথা ছাড়া লোকজন ধরলে আপনারা রাজশাহীতে থাকতে পারবেন না। আমার ছেলেরা অস্ত্র নিয়ে ঘুরবে, কোমরে ছোরা নিয়ে ঘুরবে, মদ-গাঁজা খাবে, এ সব ধরবেন না। আমাদের কাছে সব জামায়াত-শিবির শত্রু না। আমরা যখন ক্ষমতায় থাকব না তখন কিছু কিছু জামায়াত-বিএনপি নেতার দরকার আছে। জামায়াত-বিএনপির মধ্যেও আমাদের কিছু লোক আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছু মিলিয়ে আমাদের চলতে হয়। আমরা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় না থাকলেও যাতে এলাকায় থাকতে পারি সে সব ব্যাপারও আমাদের মাথায় রাখতে হয়।’

আওয়ামী লীগ নেতার মুখে এ সব শোনার পর ওসি বলেন, ‘মাননীয় পুলিশ কমিশনার ও অন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছাড়া আর কারও সুপারিশ মেনে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দায়িত্ব পালন করেই যাব। আপনাদের অযৌক্তিক অনুরোধ রাখতে পারব না।’

এ ঘটনার পরই নিজ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওসি আলমগীর হোসেন। ৩১ জানুয়ারি নথিভুক্ত করা ওই জিডির নম্বর ১৫১৭।

তবে জিডির প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বোয়ালিয়া থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেছেন, ‘ডাবলু সরকারের অফিসে নানা কারণে আমরা যাই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা হয়। এ সব মনে থাকে না।’

অভিযুক্ত রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘শিবিরের কোনো কর্মীকে ছাড়িয়ে নিতে ওসির সঙ্গে আমার কথা হয়নি। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কোনো আপস করবে না।’

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হয়তো কোথাও কোনো ভুল হয়েছে কিংবা আমাকে হেয় করার জন্য কেউ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের বিভ্রান্ত করেছে।’

কেবল রাজশাহী নয়, আওয়ামী লীগ নেতাদের এরকম তদবিরের ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রামের রৌমারীতেও। পুলিশের হাতে আটক শিবিরকর্মী রমজান হোসেন (২২) ও নবির হোসেনকে (৩৩) থানা থেকে ছাড়াতে ১২ মার্চ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মিনু ও সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম তদবির করেন বলে জানা গেছে।

রৌমারী থানার ওসি সোহরাব হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, জামায়াত-শিবিরের ওই দু’জন হরতাল ও অবরোধকে কেন্দ্র করে শহরে নাশকতার চেষ্টা করেছিল। আর এ কারণেই তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে নাশকতা চেষ্টার মামলাও হয়েছে।

তাদের ছাড়াতে থানায় গিয়ে পুলিশের ওপর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা চাপ সৃষ্টি করেছিলেন বলেও ওসি জানান।

তিনি আরও জানান, উপজেলার রৌমারী গ্রামের হামিদুল ইসলামের ছেলে রমজান হোসেন ও বাউসমারী গ্রামের ময়েনউদ্দিনের ছেলে নবির হোসেন জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জড়িত। তারা নাশকতা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পনা করেছে। এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। অথচ তাদের ছাড়িয়ে নিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের তদবির দুঃখজনক।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘ওই দুজনের সঙ্গে পুলিশ আরেকজনকে আটক করেছিল। আখতার হোসেন (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে। এর কারণ জানতে চেয়ে পুলিশকে বলেছিলাম, একজনকে ছেড়ে দিয়েছেন বাকি দুজনকেও ছেড়ে দেন।’দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই