প্রসেনজিতের আপত্তিকর মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে সায়ন্তনীর খোলা চিঠি
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নায়ক প্রসেনজিতের মন্তব্যে বিক্ষুদ্ধ সকলে। শুধু বাংলাদেশী জনগণ নয়, ভারতীয় অনেক সচেতন মানুষও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার প্রতি। তেমনই একজন সায়ন্তনী পুততুন্ড। এই লেখিকার কাহিনী ও চিত্রনাট্যে গৌতম ঘোষ নির্মাণ করছেন ‘শঙ্খচিল’। এতে অভিনয় করছেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী কুসুম শিকদার এবং স্বয়ং প্রসেনজিৎ।
সম্প্রতি প্রসেনজিৎ তার অফিসিয়াল ফেসবুকে লিখেন ‘বাঘের কিন্তু জাত আলাদা হয়, বেড়ালকে ভুল করে বাঘ না ভাবাই ভালো’। আর এ নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এদেশের ক্রিকেট ভক্তরা। কারন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের মনোগ্রাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যদিও প্রসেনজিৎ বিষয়টির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার পাশাপাশি মন্তব্যটি ফেসবুকে থেকে সরিয়ে ফেলেছেন। তবুও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার সায়ন্তনী প্রসেনজিতের এমন আপত্তিকর মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে খোলা চিঠি লিখেছেন তার প্রতি-
মাননীয় অভিনেতা,
খুব অল্প কথায় দু একটা জিনিস বলে দিই। আমি আপনার মত বিরাট বিখ্যাত মানুষ নই। আপনার মত ফ্যান ফলোয়ারও নেই, সেলিব্রিটি হওয়া তো দূর।
আমি একজন সামান্য লেখক মাত্র। সেই লেখক, যাঁদের মাথা থেকে বেরোনো গোটা পরিকল্পনা ও চরিত্রগুলোতে অভিনয় করে নাম করেন আপনারা। হাততালি কুড়োন। অথচ এত বড় কর্মকান্ড যে মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছে, সেই মস্তিষ্কটি থাকে অনেক দূরে। আপনারা লাইম লাইটে ঝলসে ওঠেন। আর আপনার অভিনীত চরিত্রটির স্রষ্টা থাকেন অন্ধকারে। আমি সেইরকমই অন্ধকারে থাকা একটি স্রষ্টা। আপনার জন্য একবার কলম ধরেছি মাত্র। নামে ছোট, দামে ছোট, বয়েসেও অনেক ছোট। তাই যা বলছি, ছোট মুখে বড় কথা হিসেবে নিয়েই ক্ষমা করে দেবেন আশা করি।
আপনার পোস্টে সবকিছু লেখার স্বাধীনতা আপনার আছে। নিজের চরিত্রের ডায়লগ দেওয়ার অধিকার তো বটেই। কিন্তু যখন ডায়লগ লিখবেন, তখন সেটাকে কোট-আনকোট নামক একটি বস্তুর মধ্যে ফেলে নির্দেশ করে দেওয়া ভালো। নয়তো আপনি লালনের মূর্তি গড়তে গিয়ে সেটা যদি লাদেন করে ফেলেন, মানুষ তো চেঁচাবেই। তাই বলছি, দুমদাম কিছু নাই বা বললেন, আর বললেও নীচে ক্যাপশন থাকা জরুরী।
বাংলাদেশের প্লেয়াররা বাঘ না বিড়াল, সেটা পরের কথা। আমার কাছে সবচেয়ে বড় কথা—ওরা বাঙালি। যেখানে আমরা এগারোজনের টিমে একজন বাঙালি খেললে গর্বিত হয়ে উঠি, সেখানে এগারোজন বাঙালি প্রাণপণ খেলে প্রমাণ করছে, ওরা খেলতে জানে। ভারতীয় নয়, শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার জন্যই আমরা গর্বিত হতে পারি। ওরাও সৌরভ গাঙ্গুলির জন্য গলা ফাটাত, এখনও ফাটায়। কেন? কারণ তিনি বাঙালি—কোন দেশের দেখার দরকার নেই, কারণ শেষমেষ তিনি বাঙালিই। ভারতীয় বোর্ড কর্তারা ভাবতেই পারেন না, অলস, ভেতো-মেছো বাঙালিরা আদৌ খেলতে জানে। স্বয়ং সৌরভ গাঙ্গুলিও শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার অপরাধে অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন। বাংলাদেশ কিন্তু হাতে কলমে প্রমাণ করে দিচ্ছে। মাছ ভাত ডাল খাওয়া নিরীহ বাঙালিরাও কিন্তু মাঠে নামলে ধ্বংসাত্মক হতে পারে। আপনার তো গর্ব হওয়া উচিত! আপনিই তিনি না, যিনি লালনের ভূমিকায় আপামর বাঙালিকে হাসিয়েছিলেন, কাঁদিয়েছিলেন। এবং আপনিই তিনি, যিনি বাংলাদেশের সীমান্তে থাকা ‘বাদলের’ চরিত্রে অভিনয় করবেন এবং করছেন। বাংলাদেশেরই প্রযোজক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার পরম বন্ধুত্ব। তাহলে এমন একটি মন্তব্য দুম করে বলে ফেলার আগে আপনার কি ভাবা উচিত ছিল না যে কোনও দেশের মানুষকে, কোনও সংস্কৃতিকে ঘা দেওয়া ঠিক নয়? অজান্তেই কিছু মানুষকে ব্যথা দেওয়ার অধিকার আপনার নেই। আর বলিহারি তাদের, যারা আপনার সেই পোস্টটিকে ‘লাইক’ও করলেন!
মানলাম, আপনি হয়তো অজান্তেই আঘাত করে ফেলেছেন। কিন্তু মন্তব্য গুলো দেখেও বুঝতে পারেননি যে কিসের ভিত্তিতে সেগুলো করা হচ্ছে? এবং ‘কুরুচিকর’ মন্তব্য দেখে আপনি দুঃখিত! আপনি তো এতটা নির্বোধ নন্! একবারও ভেবে দেখবেন না, যে আপনার পোস্টটি কতটা সুরুচীর পরিচায়ক। আঘাত দিলে পালটা আঘাত তো খেতেই হবে। ‘অমর প্রেম’ এর ডায়লগ হঠাৎ এখনই আপনার মনে পড়ল কেন? এখন তো অমর প্রেম নয়, আপনি শঙ্খচিল এ ডুবে আছেন! ‘বাদল’ এ ডুবে আছেন—অন্তত তেমনই তো জানি! প্রতিটি মিডিয়া জানিয়েছে আপনি পুরোপুরি বাদলের চরিত্রে ঢুকে গিয়েছেন! আপনি নিজেই বলেছেন স্যার। এবং যতদূর আমার ধারণা ‘শঙ্খচিল’এ এমন কোনও ডায়লগ নেই। ‘বাদল’ তো আমার নিজেরই হাতে গড়া। তাকে আমিই তৈরি করেছি তাই আমার সন্তানের খুঁটিনাটি বেশ ভালোভাবেই জানি। এমন সংলাপ সে দিতেই পারে না! আমি তো লিখিইনি, গৌতম ঘোষও নির্ঘাৎ স্ক্রিপ্টে কিছু লেখেননি। ‘অমর প্রেম’ এর বদলে ‘শঙ্খচিল’এর ডায়লগ লিখলে তবু বুঝতাম—কিন্তু এ কী! শঙ্খচিলের বদলে বহু পুরনো অমর প্রেম এল কোথা থেকে?
যাই হোক, ভুল যখন স্বীকার করেছেন তখন আর বেশি কিছু বলার দরকার নেই। বেনিফিট অব ডাউট আপনাকে দেওয়াই যায়। হয়তো বাঙালি আপনাকে ক্ষমাও করে দেবে। কারণ সহ্যশক্তি, ক্ষমা করে দেওয়া, ভদ্রতা, নম্রতা প্রত্যেকটি বাঙালির রক্তে আছে—হয়তো অনেকেই এটাকে বাঙালির দুর্বলতা ভাবেন। কিন্তু এই সহনশীল লোকেরাই যদি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তবে কী হয় তার প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে আমরা বহুবারই দেখে এসেছি। সুতরাং শুধু ক্ষমা নয়, নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে নেওয়াই উচিত আপনার।
বন্ধু যারা আছেন, আর যারা বন্ধু নন, তাদের কাছে একটাই অনুরোধ—নায়কের ‘ভুল’ টাকে ভুল ভেবেই ক্ষমা করে দিন না। হয়তো তিনি সত্যিই এমন কিছু বলতে চাননি। ব্যাপারটা নেহাতই ভুল বোঝাবুঝি। উনি ক্ষমাও চেয়েছেন। আমরা কি আরেকটু উদারতার সঙ্গে তার এই ভুল মাফ করে দিতে পারি না? মনে হয় পারি।
আর এর থেকে একটা শিক্ষা অন্তত নিয়ে নিন। আপনি যে ভাষায় কথা বলেন, সেটা বাংলাভাষা। আপনি যেখানে থাকেন, সেটা একসময়ে অবিভক্ত বাংলাদেশের মধ্যেই পড়ত। আমরা যতই ‘র্যা ট, ম্যাট, ক্যাট’ ডায়লগ মারি—আমাদের পূর্বজরা ভাত-মাছ খেতেন, আমরাও খাই। গঙ্গা, পদ্মা দুই নদীই কখনও আমাদের ছিল। এক মাথামোটা র্যাভডক্লিফ নামক সাহেব গদাম করে একটা লাইন না টেনে দিলে আজও আপনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের দেখা অবিভক্ত বাংলাদেশেরই মানুষ হতেন। আপনার আমার শিক্ষা, সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের মাটি মিশে আছে। আমি গর্বিত, আমি বাঙালি। আরও ভালোভাবে বললে—বাঙাল! ঐ মাটিটাও একদিন আমার পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল।
আমার নিজের দাদু স্বদেশি আন্দোলনে জেলে পচার সময়ে ভাবেননি, কোন্ বাংলার হয়ে লড়ছেন! তিনি জানতেন—মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্য লড়ছেন। তার ভাই, মায়ের কাকু বুকে গুলি খেয়ে মরেছিলেন, তবু বাংলাভাষা বলতে ছাড়েননি। তার মত কত বাঙালিকে দাঁড় করিয়ে গুলি মারা হল, তবু নিজেদের সংস্কার, সংস্কৃতি, মাতৃভাষা তাঁরা ছাড়লেন না। আমরা এখন লায়েক হয়েছি। বাংলা বলতে জানি না বলে গর্বিত হই। বাঙালির বাচ্চা হয়ে ‘আংরেজ ছলে ঘ্যয়ে, বেংলিশ কো চৌউড় ঘ্যয়ে’ হয়েছি। মা কে ‘মম্’ বলতে শিখেছি, বাবাকে ‘ড্যাড’ বা ‘পাপা’। এর জন্য আমরা লজ্জিত নই। কিন্তু যারা আমাদের মত পাঁচমেশালি না হয়ে নিজেদের গৌরব বহন করে চলেছেন, তাঁদের একটু সম্মান কি করতে পারি না? যতই ‘হাঁউ-মাঁউ-চাউ’ বলি না কেন, লাঞ্চে ‘পিৎজা বা পাস্তা’ খ্যাঁটাই না কেন, বাড়ি ফিরে দিনান্তে তো সেই ডাল, ভাত, মাছই খাবো! যন্ত্রণার আকস্মিকতায়—‘ওহ্ মাই গড’ বলব না, মুখ দিয়ে বেরোবে সেই অমোঘ শব্দ গুলোই—‘উঃ মা!’ অথবা ‘মা গো!’
সুতরাং নায়ক, গায়ক, শিক্ষক, ডিস্কজকি, রেডিও জকি, লেখক—যাই হই না কেন, দিনান্তে আমরা সেই আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি। বাংলার শিল্প, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এবং যে মানুষ নিজের শিকড়, নিজের সংস্কৃতিকে সম্মান করে—গোটা বিশ্বও তাঁকে সম্মান করে। অন্যথায় ব্যাপারটা ভাইস ভার্সা। আশা করি ভুল বুঝবেন না, এবং এই অকিঞ্চিতকর মানুষটির স্পর্ধা ক্ষমা করবেন! ভালো থাকুন।
– সায়ন্তনী পুততুন্ড
আরো পড়ুন :
মন্তব্য চালু নেই