হাসিনাকে খালেদার আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। পরবর্তীতে সংসদ ভেঙে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।’

খালেদা জিয়ার শুক্রবার দেওয়া এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতিতে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সমঝোতায় আসলে দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।’

ওই দিন গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী কমিটি ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে এমন মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা (বিরোধী দল) দশম সংসদ নির্বাচনের ট্রেন মিস করেছেন। এবার অবরোধ বন্ধ করেন, গাছ কাটা বন্ধ করেন, জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে মানুষ হত্যা বন্ধ করেন।’

তিনি বলেন, ‘আলোচনা চলতে থাকবে। সমঝোতায় আসতে পারলে নতুন নির্বাচন দেব।’

শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের গুরুত্বপূর্ণ এ সভায় কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্য শেষে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের আশা ছিল বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে। এজন্য আমরা জোটগতভাবে ছাড় দিয়ে প্রার্থী ঠিক করেছি। যখন বিরোধী দল নির্বাচনে আসেনি, তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটা স্বাভাবিক। তারপরও নির্বাচনে ১২টি দল ও ৫৪০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিচ্ছে।’

বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘খুঁজে খুঁজে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি-ঘর পোড়াচ্ছেন। মানুষের ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে, সহ্যেরও একটা সীমা আছে। এ সব কর্মকাণ্ড আর বরদাশত করা হবে না। মানুষ হত্যা বন্ধ না করলে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য যত কঠোর হওয়া দরকার তত কঠোর হব।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিরোধী দল অবরোধ দিয়ে তো কিছুই করতে পারল না। উনার (খালেদা) অবরোধ শুধু দিনমজুর আর খেটে খাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে। আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেন ক্লাস পরীক্ষা দিতে না পারে তার জন্য।’

এর দুই দিন পর ২১ ডিসেম্বর শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগের বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আলোচনা চলছে, আলোচনা চলতে থাকবে। ভবিষ্যতে সমঝোতা হলে, আপনাদের (বিএনপি) দাবি (ডিমান্ড) যদি থাকে তাহলে সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন দেব। তবে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে হবে, হত্যা বন্ধ করতে হবে, বিভিন্ন স্থানে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চলছে, তা থামাতে হবে।’

একই দিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনির্য়াস মিলনায়তনে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আলোচনাও চলবে, ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী, বিরোধী দল যদি জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন, হরতাল-অবরোধ ও নাশকতা বন্ধ করে তাহলে আলোচনার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।’

নির্বাচনের বিষয়ে বিরোধীদলীয় নেতার উদ্দেশে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা মেনে অগণতান্ত্রিক কর্মসূচি বন্ধ করুন। নির্বাচনের পরে একাদশ সংসদ হবে, নতুন মন্ত্রিসভা হবে। আমরা আশা করি, আলোচনায় বসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলায় নির্বাচন করতে পারব।’

২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য। ২০১০ সাল থেকে বার বার আমি বিএনপি নেত্রীকে আহ্বান জানিয়েছি আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে এগিয়ে আসতে। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে স্বরাষ্ট্রসহ যেকোনো মন্ত্রণালয় দিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম। আমি নিজে টেলিফোন করে বিরোধীদলীয় নেতাকে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছি। তিনি সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছেন। বার বার আমাকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারই (খালেদা) দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম, জনগণের ওপর আস্থা রেখে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিবে। কিন্তু আমাদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই।’

‘শুধু তাই নয়, হরতাল ও অবরোধের নামে মানুষকে জিম্মি করে সন্ত্রাস ও নাশকতা সৃষ্টি করেছে। বায়তুল মুকাররম মসজিদে আগুন দিয়েছে। পবিত্র কোরআন শরীফ পুড়িয়েছে। মলোটভ ককটেল আর পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। পুলিশ, বিজিবিসহ অনেককে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, লুটতরাজ করেছে। রাস্তা কেটে, রেল লাইন উপড়ে ফেলে, গাছ কেটে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তারা চেষ্টা করেছে।’

জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একটি নির্বাচিত সরকার হিসেবে আমরা গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছিলাম। তাই, সাংবিধানিকভাবেই আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি আশা করি, গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত ৫ হাজার ৮০৩টি স্থানীয় সরকার ও উপ-নির্বাচনে আপনারা যেভাবে ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোট দিয়েছেন তেমনিভাবে আগামী ৫ জানুয়ারি একটি উৎসবমুখর পরিবেশে আপনারা ভোট দেবেন। পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবেন।’

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করবে। দেশে কোনো মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে না।’

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গাপুর হাইস্কুল মাঠে ওই দিন বিকেলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ সব কথা বলেন তিনি।

শেখ সেলিম বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন কেউ ঠেকাতে পারবে না। নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। ৫ জানুয়ারির পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারলে দেশের সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হবে।’

২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে মন্তব্য করে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ কতদিনের হবে তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

ওই দিন রাজধানীর সেতু ভবনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন।

ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় মন্তব্য করেছিলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার পাঁচ বছরই মেয়াদ পূর্ণ করবে।’ জয়ের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি সরকার বা দলের শীর্ষ পর্যায়ে দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি আপনাদের আগেও বলেছি সমঝোতার ব্যাপারে মধ্য জানুয়ারিতে একটি চমক থাকছে।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে এখন আর আলোচনার সুযোগ নেই। এই নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি বলেই ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল অংশ না নেওয়ায় বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা আসছেন না।’

এদিকে শুক্রবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ৫ জানুয়ারির নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর পরবর্তীতে সংসদ ভেঙে দিয়ে আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তার কথায় বিশ্বাস রেখে আমরা আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করেছিলাম। কিন্তু তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।’

খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কবে কোথায় বলেছেন ৫ জানুয়ারি নির্বাচন একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই