খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হচ্ছেন না কেন?

বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতার হবেন কি হবেন না, হলে কবে-কীভাবে হবেন, এসব নিয়ে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে। আজ (৬ মার্চ) যখন এই লেখা লিখছি, তখনও কিন্তু থেমে যায়নি এ আলোচনা। পেশাগতভাবে টেলিভিশন সংবাদের কাজে জড়িত বলে এ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার উদ্বেগ ছিল ভিন্ন মাত্রায়। প্রতিদিনই আমরা আলোচনা করতাম, গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে কবে নাগাদ বেগম জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে যেতে পারে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতাম। যদি আসলেই পুলিশ যায়, বিএনপি নেত্রীকে ধরে নিয়ে যায়, সে দৃশ্য যাতে আমাদের দর্শককে সরাসরি দেখাতে পারি, সেজন্যও প্রস্তুতি নিতে হয়েছে প্রতিদিন। ২৫ জানুয়ারি আদালত জারি করেছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। ফলে সেদিন থেকেই চলছে আমাদের সতর্কতা, প্রস্তুতি। মাঝে একদিন, গত মঙ্গলবার খবর এলো যে, পরদিন বুধবারে গ্রেফতার হতে পারেন তিনি। আসলে সেদিন তার মামলার নির্ধারিত তারিখ ছিল, যেহেতু তিনি এই মামলায় হাজিরা দিচ্ছেন না বলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, তাই ওই তারিখে তাকে আদালতে হাজির করাতে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। এই দিনটির ব্যাপারে আমরা এতটাই নিশ্চিত ছিলাম যে, ওই দিন নিউজরুমের সবার নির্ধারিত সাপ্তাহিক ছুটি পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিশ্রমও নেহায়েত প-শ্রমে পরিণত হলো।

এতটুকু পড়ে অনেক পাঠকেরই মনে হতে পারে, আমি বুঝি খালেদা জিয়ার গ্রেফতার হওয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। যদি এমন কেউ মনে করে থাকেন, তাহলে তিনি ঠিকই আছেন। আসলেই আমি আগ্রহী। অবস্থা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেফতার হওয়াটা জরুরি। আমার বিবেচনায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এটা হওয়া উচিত। বরং বলা যায়, এটা আরও আগেই হওয়া জরুরি ছিল।

আমি জোর দিয়ে বলছি না, বেগম খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার মতো কোনো অন্যায় করেছেন। সামগ্রিক পরিস্থিতির বিবেচনায়, তার গ্রেফতার যেকোনো সমাধান আমি সেটাও মনে করি না। বরং এতে জটিলতা আরও বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু তারপরও মনে করি গ্রেফতারটা হওয়া উচিত। মাননীয় বিচারক যখন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেই ফেলেছেন, তখন তা তামিল হওয়াটা জরুরি।

বিচার বিভাগ চলবে আইন অনুযায়ী। আইন অন্ধ, আইন সবার জন্য সমান। এই আইন মেনে বিচার বিভাগ যখন কোনো সিদ্ধান্ত দেবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব হচ্ছে বিনা বাক্যব্যয়ে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। পৃথিবীর সব দেশে এটাই নিয়ম। এই নিয়ম যারা মানবে না, তারা আর যাই হোক একথা দাবি করতে পারবে না যে, তাদের দেশে আইনের শাসন চলে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই আসলে টেনশনটা বিরাজ করছিল। এই সময়ে সরকার দলীয় নেতা, এমপি, মন্ত্রীরা এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে অতি সাধারণ চোর ছ্যাচ্চরের কোনো পার্থক্যই নেই। যেকোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু সেই ‘যেকোনো সময়’ আর আসে না। পরোয়ানা জারির পুরো সাতদিন পর পুলিশের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রী তার অতি পরিচিত বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন, তাদের হাতে এখনো গ্রেফতারি পরোয়ানাটা নাকি পৌঁছেনি।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যখন এই তথ্যটি দিচ্ছিলেন, তখন যেন তাকে আরও বেশি বিনয়ী দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অনেক কষ্ট করে তিনি বলছেন কথাটা। তিনি কি লজ্জিত হচ্ছিলেন? যদি লজ্জা পেয়ে থাকেন, তাহলে মন্দের ভালো।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পুরো সাতদিনেও বকশীবাজার থেকে গুলশান পুলিশ স্টেশনে কেন পৌঁছতে পারল না এই গ্রেফতারি পরোয়ানা? আজকাল ইন্টারনেটে সবকিছুই পাওয়া যায়। সরকারও ডিজিটাল ডিজিটাল বলে মানুষের মনে ইন্টারনেটের প্রতি আগ্রহ ঢুকিয়ে দিয়েছে। তো আমিও সেই নেটে গিয়ে দূরত্বটা বের করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম বকশীবাজার থেকে গুলশান পুলিশ স্টেশনের দূরত্ব ৯.১ কিলোমিটার। সামান্য এই দূরত্ব সাতদিনেও অতিক্রম করতে পারল না কেন গ্রেফতারি পরোয়ানা। কোন মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল সেটি? কচ্ছপের মাধ্যমে নিশ্চয়ই নয়। কারণ, নেট থেকে কচ্ছপের গতিটাও এরই মধ্যে বের করেছি, দেখেছি সবচেয়ে ধীরগতির কচ্ছপের পিঠে করে পরোয়ানাটি পাঠালেও এই দূরত্ব অতিক্রম করতে তার মাত্র ৩৬ ঘন্টার মতো সময় লাগত। তাহলে আমাদের ডিজিটাল এই রাষ্ট্রযন্ত্রের গতি কি কচ্ছপের চেয়েও কম?

এই পর্যায়ে এসে মনে হলো, আসলেই কি সরকার গ্রেফতার করতে চায় বেগম জিয়াকে? না চাইলে এমন নাটকের অবতারণা করা কেন, যাতে সরকারকেই বিব্রত হতে হবে? তারও আগে প্রশ্ন ওঠতে পারে, দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা কি খুবই অবধারিত ছিল? নাকি বিএনপি নেত্রীর আইনজীবীরা সুকৌশলে এমন সব আচরণ করেছে যার কারণে এ ধরনের একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

দুটি দুর্নীতি মামলায় ধার্য তারিখে হাজির না হওয়ায় ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এই মামলায় ৬০ কর্মদিবসে খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হয়েছেন মাত্র সাতবার। তার অনুপস্থিতির কারণে মামলাটি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। সে কারণেই গ্রেফতারি পরোয়ানা। বিপরীত দিকে, বিএনপির এক আইনজীবী বললেন, নভোথিয়েটার মামলায় শেখ হাসিনা নাকি আদালতে হাজিরা দেননি। চার বছর চলেছিল সেই মামলা, শেখ হাসিনা নাকি একদিনও হাজিরা দেননি। তখন ছিল বিএনপির সরকার। কই তখন তো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়নি। বিপরীত দিকে, বেগম জিয়া তো বেশ কয়েকবার সশরীরে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন।

তবে এসব প্রশ্ন আমরা করতে পারি না। ওনারা রাজনীতিবিদ, আইনজীবী। অনেক কিছুই ওনারা পারেন, আমরা পারি না। বিচারক যখন পরোয়ানা জারি করে ফেলেছেন, তখন এর যথার্থতা নিয়ে আর প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমাদের প্রশ্ন বিচারকের রায় বাস্তবায়ন নিয়ে। পরোয়ানা হাতে পৌঁছেনি বা পরোয়ানা শম্বুকগতিতে (বলা দরকার, নেটে দেখেছি কচ্ছপের চেয়ে শামুকের গতি আরও অনেক কম) গুলশান থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এসবকে সাধারণ মানুষের কাছে নিছক অজুহাত মনে হতেই পারে। নিয়ম হচ্ছে বিচারকের রায় বিনাপ্রশ্নে বাস্তবায়ন করাই পুলিশের কাজ। কিন্তু বাস্তবে সেটা কি হয়ে থাকে এই দেশে? এমন সংবাদ তো আকছারই পত্রপত্রিকায় দেখা যায় যে, কোনো এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে, কিন্তু পুলিশ তাকে ধরছে না। পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসা করলে অবলীলায় বলছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম ক্ষেত্রে আইনের শাসন নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। মানুষ বোঝে সবই, কিন্তু কিছু বলার থাকে না। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে তো আর খুঁজে না পাওয়ার অজুহাতটি ধোপে টিকবে না। তাই এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, পরোয়ানা এখনো পুলিশের হাতে এসে পৌঁছেনি! কি সুন্দর রাজনীতি! এতটাই সুন্দর যে, নিতান্ত অসহায় সেখানে বিচারের বাণী।

বিশ্লেষকরা অবশ্য বিষয়টাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাদের মতে, দেশের রাজনীতি আসলে এখন একটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ পৌঁছেছে। দুই কূল রক্ষা করে এখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। দুই নেত্রীই যার যার মতো জেদ ধরে বসে আছেন। হরতাল- অবরোধের কার্যকারিতা কমতে কমতে শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে জেনেও একজন তার কর্মসূচি থেকে সরছেন না। আর সংলাপের কথা বললেই পেট্রল বোমার আতঙ্ক থেকে ১৬ কোটি মানুষ রক্ষা পেতে পারে জেনেও একজন আলোচনার কথা বলছেন না। উভয়েই মনে করছেন, এতে বুঝি তাদের পরাজয় হবে, রাজনৈতিকভাবে তারা বুঝি হেরে যাবেন। জয়ের নেশায় তারা যে জনগণকেই নির্মমভাবে পরাজিত করে চলেছেন প্রতিনিয়ত সেটা বিবেচনায় নিচ্ছেন না কেউই।

এ রকম বাস্তবতার মধ্যেই জারি হলো খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত এই গ্রেফতারি পরোয়ানা। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ ভেবেছিল এই পরোয়ানার পর ৪ মার্চ মামলার পরবর্তী শুনানিতে খালেদা জিয়া সশরীরে হাজির হবে আদালতে। সেখানে তিনি জামিন চাইলে জামিন হয়ত পেয়েও যাবেন। এতে লাভ যেটা হবে, খালেদা জিয়াকে তার গুলশান অফিস থেকে বের করা যাবে। একবার বের হলে তাকে আর এই অফিসে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আইন অনুযায়ী কাউকে নিজের ভাড়া করা অফিসে ঢুকতে না দেওয়ার এখতিয়ার আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার থাকার কথা নয়। তবে এ দেশে সবই সম্ভব। বাসার সামনে বালি ট্রাক রেখে যেমন বের হওয়া বন্ধ করার উদাহরণ রয়েছে, তেমনি বাইরে থেকে বাসার মধ্যে প্রবেশ থামাতে ময়লার ট্রাক বসিয়ে রাখার উদাহরণ তৈরি করারও সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু হয়নি। ৪ মার্চ খালেদা জিয়া আদালতে যাননি। আদালতে তার আইনজীবীরা গিয়ে বরং উত্তেজনা তৈরির মতো আচরণ করেছেন। আদালত আগের দেওয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা বাতিল করেননি, বরং সেটা বহাল রেখেছেন। পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ এপ্রিল। মানে আগামী এক মাস সময়জুড়ে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার একটা সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে অথবা আগামী এক মাসেও এই পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট থানা পর্যন্ত না পৌঁছে একটা বিশ্বরেকর্ড তৈরির সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

আসলে রাজনীতির এই দাবা খেলায় এতদিন আওয়ামী লীগ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থাতেই ছিল। লাগাতার হরতাল খেটেখাওয়া মানুষকে খুশি করতে পারেনি। তারপর যাত্রীবাহী বাসে পেট্রল বোমা নিক্ষেপের ঘটনাকে প্রচার কৌশলের জোরে পুরোপুরিই বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দিতে যে প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগের ছিল, তা অনেকটা সফলতাও পেয়েছিল। এমনকি শেষ দিকে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিকে জঙ্গিবাদের সমার্থক বলেও একটা আওয়াজ তুলেছে তারা।

এরকম সময়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে নিয়ে গেছে সরকারকে। পরোয়ানা একটা জারি হয়েছে, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। বাস্তবায়ন করা হলে তা দেশে-বিদেশে কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা করা যাচ্ছে না। তার ওপর এই গ্রেফতারটা যদি মারাত্মক কোনো মামলার কারণে হতো, তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু পরোয়ানাটা জারি হয়েছে অতি ছোটখাটো অর্থ আত্মসাতের মামলায়। যে দেশে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার আসামিও অবাধে বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারে, সেখানে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের বিতর্কিত অভিযোগে তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর জামিন বাতিল করে গ্রেফতার করার ঘটনা মানুষ সহজভাবে নাও নিতে পারে।

সব মিলিয়ে এটা যে একটা উভয় সংকট, তা মানছেন অনেকেই এবং ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, মানুষ কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে এই সংকটে কোন দল কতটা বিব্রত হয় সেটা দেখার জন্য।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।



মন্তব্য চালু নেই