তোমরাই রিয়েল হিরো

২০০৯ সালের জানুয়ারি। ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়াম। ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ ম্যাচের কথা মনে আছে? শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তী খেলোয়াড় মুত্তিয়া মুরালিধরনের মত নামমাত্র টেল-এন্ডার ব্যাটসম্যান রুবেল হোসেনের এক ওভারে ২০ রান নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। সেদিন বাংলাদেশি ক্রিকেট ভক্তদের কাছে রুবেল ছিলেন খলনায়ক।

২০০৯ থেকে ২০১৫। লম্বা সময়। এর ভেতর অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ক্রিকেট মোড়লদের কটাক্ষ, টেস্ট স্ট্যাটাস তুলে নেওয়ার হুমকি আর ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো দুঃখজনক ঘটনার ভেতর দিয়ে গেছে আমাদের ক্রিকেট। বারবার হোঁচট খেয়ে সঠিক সময়ে উপযুক্ত জবাব দিয়ে টাইগাররা পুনরায় ফিরে এসেছে নিজের অবস্থানে।

২০১৫ সালের ৯ মার্চ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অবীস্মরণীয় একদিন। সেদিন বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের নক- আউট পর্ব কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে। এ ছাড়া এদিন বহু প্রতিক্ষীত বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির দেখাও পায় বাংলাদেশ।

মাহমুদউল্লাহ বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করেন। মাহমুদউল্লাহ আর টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে বাংলাদেশ লড়াই করার একটি মজবুত ভিত পায়। খেলা চলাকালীন ম্যাচ কখনো বাংলাদেশের দিকে, কখনো ইংল্যান্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

কথায় আছে, শেষ ভাল যার সব ভাল তার। এই শেষের কাহিনীটাই কালকের ম্যাচে বিশেষ আলোচ্য। ২০০৯ সালে যে রুবেল বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের কাছে খলনায়ক ছিল, সেই রুবেলই ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে নায়ক বনে গেলেন। অথচ এইদিনও খলনায়ক হওয়ার ঝুঁকি ছিল তার।

কালকের জয়টা এমন এক সময়ে এসে ধরা দিল, যখন জাতিগতভাবে বাংলাদেশিরা কঠিন এক সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, টানা অবরোধ, হরতাল, পেট্রোল বোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, হত্যা, খুন আর গুমের মত ঘটনা যখন অহরহ ঘটছে, মানুষ ঘর থেকে বের হতে যখন ভয় পাচ্ছে, ঠিক তখনই মহাকাব্যিক এক জয় এসেছে ক্রিকেট থেকে।

যে জয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েছে পুরো জাতি। বাধ ভাঙা উল্লাসে রাস্তায় মিছিল, বিশ্ববিদ্যালগুলোর শিক্ষার্থীদের জয় উদযাপন, সবকিছু মিলিয়ে এই জয়ে সব বিভেদ ক্ষণিক সময়ের জন্য ভুলে কাল ক্রিকেট সুরায় মাতাল হয়েছে জাতি।

বাংলাদেশে বোধ হয় আর কোনো উপলক্ষ নাই যার জন্য সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে এসে সামিল হবে সবাই। উল্লাস করবে এক সঙ্গে, নাচবে, উদযাপন করবে। একমাত্র ক্রিকেটই পারে এমন উপলক্ষ এনে দিতে। তাই ক্রিকেটারদেরই প্রকৃত হিরো মনে হয় আমার। যারা সমগ্র জাতিকে এক সুতায় বেঁধে দিতে পারেন।

অগণিত রাজনৈতিক বিভাজনের মাঝে ক্রিকেটই একমাত্র উপলক্ষ যা গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফি জয়, ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপে শক্তিশালী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়সহ বাংলাদেশের প্রতিটি জয়ে দলমত নির্বিশেষে সবাই এক সঙ্গে প্রাণে প্রাণ মিলায়।

লেখাটা শুরুর কথা দিয়েই শেষ করবো। মুরালির কাছে রুবেল মার খেয়ে যেদিন হেরেছিল, সেদিন প্রতীজ্ঞা করেছিলাম বাংলাদেশের খেলা আর দেখব না। অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন। শুধু কি আমরাই কাঁদি ক্রিকেটের জন্য। খেলোয়াড়রা কাঁদে না? মনে আছে এশিয়া কাপ ফাইনালে পাকিস্তানের সঙ্গে জয়ের দ্বারপ্রান্ত পৌঁছে দুই রানে হারার পর সাকিব-মুশফিকের সেই কান্না!

১৬ কোটি মানুষের আবেগ অনুভূতির কথা মাশরাফি-মুশফিকরাও জানে। প্রতীজ্ঞা করেছিলাম বাংলাদেশের খেলা দেখবো না। কিন্তু মন কি আর মানে। তাই তো কাল আবার কাঁদলাম। জীবনে এই প্রথম মধুর কান্নায় আপ্লুত হয়েছে হৃদয়।

একমাত্র ক্রিকেট, বাংলাদেশের সোনার ছেলেরাই এই রকম কান্নার ক্ষণ এনে দিতে পারে। তাই হারলেও বাংলাদেশ, জিতলেও বাংলাদেশ।



মন্তব্য চালু নেই