স্বস্তিতে নেই আওয়ামী লীগ
স্বস্তিতে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দুই মাসের বেশী সময় ধরে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, নাশকতা ও আন্তর্জাতিক মহলের নানামুখী তৎপরতা ক্ষমতাসীনদের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনড় মনোভাব এর অন্যতম কারণ। আন্দোলনের নামে অব্যাহতভাবে নাশকতা চালিয়ে গেলেও নাশকতাকারী হিসেবে বিএনপি জোটের কপালে এর ‘তকমা’ লাগাতে সফল হয়নি ক্ষমতাসীনরা। সারাদেশে দলীয় নেতাকর্মী খুন হওয়ার ঘটনা ও চলমান পরিস্থিতিতে সারাদেশে ব্যাপকহারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে না পারায় অস্বস্তিতে পড়েছে ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। অবশ্য এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল নির্ধারণ করছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
সূত্রে জানা গেছে, ৩ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১৬ দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাটের সঙ্গে আলাদা ৫ মিনিট কথা বলেছেন। এ সময় বার্নিকাট খালেদাকে নাশকতা বন্ধের আহ্বান জানান। জবাবে খালেদা নাশকতার সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয় দাবি করে বেশ কয়েকটি পত্রিকার কাটিং উপস্থাপন করেন বার্নিকাটের কাছে। পাশাপাশি নাশকতার সঙ্গে সরকার জড়িত বলে দাবি করেন খালেদা জিয়া।
শীর্ষপর্যায়ের অন্তত ৫ জন নেতা মনে করেন, বিদেশী তৎপরতা এখনও সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও কতদিন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা বলা মুশকিল। তারা বলেন, কুটনীতিকদের অবস্থান আপাতত সমান্তরাল। কিন্তু কখন কোনদিকে হেলে পড়ে আর কোথাকার জল কোথায় গড়ায়? অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে অস্বস্তির ব্যাপারগুলো উঠে এলেও প্রকাশ্যে কথাবার্তায় দলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা এ সব বিষয় এড়িয়ে যান। গত দুই দিন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন নেতার কথা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর সুব্রামানিয়াম গত ২ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাকে (জয়শঙ্কর) জানানো হয়, চলমান হরতাল-অবরোধে সহিংসতা ঘটাচ্ছে বিএনপি। এ বিষয়ে আলোচনার সময় নিরপেক্ষ থাকার জন্য জয়শঙ্কর চুপ করে শুধু কথা শুনেছেন। কোনো মন্তব্য করেননি। জয়শঙ্করের চুপ থাকার বিষয়টিতেও অস্বস্তি বেড়েছে আওয়ামী লীগে।
সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, দেশে দুই মাস ধরে নাশকতা চলছে, জ্বালাও-পোড়াও চলছে। ফলে সরকারের ভেতর অস্বস্তির কারণ থাকেই। তিনি বলেন, হঠাৎ করে বিদেশী কুটনীতিকদের তৎপরতা আপনারাও দেখছেন, আমরাও দেখছি। কিন্তু এটাকে চাপ বলতে চাই না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এ লড়াই স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের। সুতরাং দ্রুত শেষ হয়ে যাবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে ঠিক, কিন্তু সরকার তার লক্ষ্যে পৌঁছবেই। তিনি বলেন, সরকারে থাকার কারণে অস্বস্তি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মতে, সংসদে, সংসদের বাইরে এমনকি বিরোধী দল হিসেবে কোনো পদ-পদবী বা অবস্থান নেই বিএনপি চেয়ারপারসনের। তবুও সম্প্রতি খালেদা জিয়াকে ঘিরে আন্তর্জাতিক তৎপরতা বেড়েছে। এটি কোনোভাবেই ক্ষমতাসীনদের জন্যে সুখকর নয়। ক্ষমতাসীনরা মনে করছে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অস্বস্তির জায়গায় বিদেশীরাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী বলেন, গত দুই মাস বিএনপি চেয়ারপারসন হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে তাদের আন্দোলন ব্যর্থ করে দিয়েছে। জনগণ আতঙ্কিত হলেও জনজীবন প্রায় সচল করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। তিনি বলেন, মার্চে খালেদার সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৬ কুটনীতিকের চিঠি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে বিএনপি নেতা ওসমান ফারুকের বৈঠক- এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপির সফলতার ইঙ্গিত বহন করে। আর এ সব যোগসূত্র ক্ষমতাসীনদের অস্বস্তির কারণ বলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, চলমান পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে পশ্চিমা প্রায় সবগুলো দেশই একযোগে হস্তক্ষেপ করা শুরু করেছে। চলমান পরিস্থিতির সমাধান আশা করে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পৃথক দুটি চিঠি দিয়েছেন। এর পর ১৬টি দেশের কুটনীতিকের খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি দেওয়ায় তৎপরতা বাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, বিদেশী তৎপরতার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীকে কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও মিলিত হতে হয়েছে।
কূটনীতিক তৎপরতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, বিদেশীদের চাপ নেই। সরকার তার নিজস্ব কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য আওয়ামী লীগের ভিন্ন একটি অংশ মনে করে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা দুই মাসের আন্দোলন কর্মসূচির ফলে ধারাবাহিক কূটনীতিক তৎপরতায় সরকার ও সরকারবিরোধী জোটের পরস্পর অনমনীয় অবস্থান কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী জোট দু’পক্ষকেই ছাড় দিয়ে সমাধানের পথে আসতে হবে। তবে শুভবুদ্ধির উদয় হয় কিনা, তাতে সন্দিহান এ অংশটি। দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই