গুলশানের নীরব বাড়িটির দিকেই সবার দৃষ্টি

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-২। দেশের সবাই জানে। ৮৬ নম্বর সড়কটিও সবার কাছে পরিচিত। দেশ-বিদেশের অনেকে ছয় নম্বর বাড়ির কথাও শুনেছে। এক সময় সন্ধ্যা হলেই বাড়তো লোকজনের সমাগম। স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেকেই আসতেন এই বাড়িতে। যাকে কেন্দ্র করে আসতেন তিনি থাকতেন না তারপরেও। এখন তিনি রাত-দিন থাকেন, কিন্তু এখন কেউ আসেন না। শুনশান নিরবতাই বিরাজ করছে একসময়ের জমজমাট ওই বাড়িতে।

বাড়িটি একটি দলের নেতার রাজনৈতিক অফিস। এই কার্যালয়ে দুই মাসের বেশি সময় ধরেই আছেন সেই নেতা। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথম দিকে তাকে এই বাড়িতে অবরুদ্ধ করা হলেও এখন তিনি স্বেচ্ছায় কৌশলগত কারণে অবস্থান করছেন। আরো আছেন দলটির সিনিয়র কয়েকজন নেতা, অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা সদস্যরা।

তিন জানুয়ারি থেকে এই কার্যালয়টি ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ১১ ফেব্রুয়ারির পর কার্যালয়ে আসা-যাওয়া ও খাবার প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হলে চলে আসে একধরণের নিরবতা। কিন্তু সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্বের কারনে নিরব হতে পারছেন না সংবাদকর্মী-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মশার কামড় খেয়েও তারা থাকছেন দিন-রাত।

চার মার্চের পর কার্যালয়ের সামনে তেমন কড়াকড়ি নেই, রাস্তার দক্ষিণ-উত্তর পাশের ব্যারিকেডও নেই। কার্যালয়ের ভেতরে চলছে একধরণের নিরবতা। বেশকয়েকদিন ধরেই কেউ আসছেন না খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। মাঝে মধ্যে পেশাজীবীরা আসলে নেতাকর্মীরা আসেননি। অন্যান্য দিনের মতো শনিবারেও কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে কার্যালয়ের জন্য খাবার নিয়ে আসতেও দেখা যায়নি। কেউ না আসলেও সাংবাদিক-পুলিশ সদস্যরারা আসেন নিয়মিত।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক ছিল তখন দিনের তুলনায় সন্ধ্যা রাতে নেতাকর্মীদের ভিড় জমে উঠতো। দলের প্রধান খালেদা জিয়া মূলত রাতেই এ অফিসে তার দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তাকে কেন্দ্র করেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা আসতেন। আসতেন রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। দলের নীতিনির্ধারণী নেতারাও আসতেন। অনেক রাত পর্যন্ত বৈঠক, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হতো। আবার অনেকেই দলীয় প্রধানের সাথে দেখা করতে। এতো জমজমাট থাকার পরেও এখনকার মতো গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়টি। সবার দৃষ্টিই যেন এখন ৮৬ নম্বর রোডের গুলশান কার্যালয়ের দিকে।

গত তিন জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ কার্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ওই রাতে খালেদা জিয়াকে বের হতে দেয়া হয়নি। আটকে দেয়া হয়। ব্যবহার করা হয়-ইট-বালুভর্তি ১১টি ট্রাক, রায়ট কার, এপিসি, জলকামান ও পুলিশ ভ্যান। এছাড়াও ৮৬ নম্বর সড়কের দক্ষিণ-উত্তর পাশে কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তালা লাগানো হয় কার্যালয়ের মূল ফটকসহ অন্য ফটকেও।

পাঁচ জানুয়ারির কর্মসূচি পালনেও আর বের হতে দেয়া হয়নি খালেদা জিয়াকে। ওইদিন বিকেলে কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তার গাড়ি লক্ষ্য করে পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশি বাধা পেয়ে গেটেই দাঁড়িয়েই সরকার পতন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দেন তিনি। প্রায় দুই মাস হলেও এখনো কর্মসূচি চলছে। সঙ্গে সপ্তাহজুড়ে হরতালও রয়েছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। শুরু নতুন কৌতুহলের। আদালতের নির্দেশনায় তাকে গ্রেফতার করা হবে কি না, করলেও কখন করা হবে। একইসঙ্গে ১মার্চ কার্যালয় তল্লাশি করতে পুলিশকে আদালতের নির্দেশ প্রদান নতুন মাত্রা যোগ করে।

এই নিয়ে একদিকে মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হলেও কার্যালয়ের ভিতরে অবস্থানকারীরা রয়েছেন আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে। এর পেছনে একটাই কারণ, কার্যালয়ের নিরাপত্তা সদস্য ছাড়া সবার নামে নাশকতার মামলা রয়েছে। ফলে একদিকে দীর্ঘ্ দুই মাস ধরে স্বেচ্ছা বন্দি আর শরণার্থী শিবিরের মতো থাকা-খাওয়ার সীমাহীন কষ্ট আর নতুন করে গ্রেফতারে আতঙ্কও কাজ করছে। কিন্তু মূল ব্যক্তি অনড়।

অনেক দিন আগে থেকে তার নামের আগে বিশেষণ বসে গেছে-আপসহীন। তার দলের নেতাকর্মীরা বলেন তার কারণেই বিদায় নিতে হয়েছে এরশাদের, মইন উদ্দিন-ফকর উদ্দিনের।

তার দলের প্রস্ত্তুতি এলোমেলো। নেতারা মাঠে নামছেন। কিন্তু তিনি আছেন। অনড়।

আর তার কারণেই সকলের দৃষ্টি গুলশান কার্যালয়ের দিকে।সরকারের, বিরোধী দলের, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, মিডিয়ার, পক্ষের-প্রতিপক্ষের। আসলে সবার।



মন্তব্য চালু নেই