ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলপথে মরন ফাঁদ : ভাঙ্গুড়া কৈডাঙ্গা রেলসেতুর গার্ডার উঁচু হচ্ছে

ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলপথের প্রাণঘাতী নিচু পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ২৪নং কৈডাঙ্গা ও ২৩নং বড়ালব্রিজের অবকাঠামো উঁচু করার কাজ অবশেষে শুরু করেছে রেল বিভাগ। অসচেতন যাত্রীরা ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের সময় ব্রিজ দু’টির নিচু অবকাঠামোর (খাঁচা) সাথে ধাক্কা লেগে প্রতি বছর অসংখ্য যাত্রী মৃত্যুর ঘটনা নিয়তির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী ডিভিশন সেতু দু’টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেই দায়িত্ব শেষ করে বসেছিল দীর্ঘ বছর।

উল্লেখ্য, ব্রডগেজ লাইনের ট্রেনের ছাদ থেকে এই ব্রিজ দু’টোর উপরের অবকাঠামোর (খাঁচার) দূরত্ব মাত্র আড়াই ফুট হওয়ায় এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে চলছিল। রেলওয়ের জিআরপি পুলিশ সিরাজগঞ্জ এর এক পরিসংখ্যানের দাবি মতে, ২০০৭ সাল থেকে এ ২০১৫ পর্যন্ত ওই দু’টি ব্রিজের গার্ডারের আঘাতে প্রায় ৫০০ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আরও অন্তত ২৩০ জন যাত্রী। ব্রিজের অবকাঠামো উঁচু করার দাবিতে বিভিন্ন সময়ে ওই এলাকার শুভ চেতনার মানুষরা কয়েক দফা মানববন্ধন করে রেল বিভাগকে স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন। উর্ধ্বতন রেল কর্মকর্তারা দুর্ঘটনার পর সেতু পরিদর্শন করেছেন বহুবার। কিন্তু কাজ হয়নি। বন্ধ হয়নি মরণ ফাঁদ ওই সেতুর প্রাণহানি। এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিস্তারিত সরেজমিন সচিত্র একটি প্রতিবেদন ‘কৈডাঙ্গা রেলসেতু মরণফাঁদ’ শিরোনামে গুরুত্ব সহকারে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। একই সময়ে অন্যান্য প্রিন্ট মিডিয়াতেও ওই বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে।

অবশেষে এই বেঘোরে প্রাণহানির খবর নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায় মিডিয়াতে। দুর্ঘটনা ঘটলে ওই এলাকার সহৃদয় মানুষেরা নিজ উদ্যোগে মুঠোফোনে খবর দিতেন সংবাদকর্মীদের। বিষয়টি এতোটাই পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায় যে, এলাকাবাসীরাও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন এইসব প্রাণহানির ঘটনায়। অবশেষে বিলম্বে হলেও রেল বিভাগের টনক নড়েচড়ে ওঠে। প্রথমে রেল বিভাগ সেতু দু’টির সামনে ট্রেন থামিয়ে তারপর ধীর গতিতে ব্রিজ অতিক্রমণের উদ্যোগ নেয়। এরপরই কর্তৃপক্ষ ব্রিজ উঁচু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ‘ম্যাকডোনাল স্টিল বিল্ডিং প্রডাক্ট লিমিটেড’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে সম্প্রতি।
গত বুধবার বিকেলে সরেজমিনে ভাঙ্গুড়ায় গিয়ে সেতু এলাকায় কথা হয় এই প্রকল্পের সুপারভাইজার রঞ্জিত কুমার রায়ের সাথে। তিনি জানান, ব্রিজের অবকাঠামোর উপরিভাগে ‘ম্যাটারিয়াল উইন সিষ্টেম বেচিং’ বসানোর কাজ চলছে। তবে আজ কাজ বন্ধ আছে। কয়েকদিন পর নির্মাণ সামগ্রী এলে আবার শুরু হবে।
তিনি আরও জানান, পুরাতন টপ কেটে ফেলা হচ্ছে। নতুন খাঁচা (গার্ডার) বসানো হচ্ছে। এটা বসানো হলে ট্রেনের ছাদ থেকে নতুন অবকাঠামোর টপের দূরত্ব হবে আড়াই মিটার বা ৮ ফুট। ফলে ট্রেনের ছাদে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও দুর্ঘটনা আর ঘটবে না। যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ের পাকশী ডিভিশনের বিভাগীয় প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রকল্প শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি। ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অশোক কুমার ঘোষ বলেন, এই প্রাণনাশী ব্রিজ নিয়ে আমরা উপজেলা পরিষদের সভায় রেজুলেশন করে ঢাকায় রেল সদর দফতরে দিয়েছি কয়েকবার। এখন দেখে খুব ভালো লাগছে। আর আপনাদের মৃত্যুর সংবাদ দিতে হবে না। ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মেয়র আব্দুর রহমান প্রধান বলেন, বিশেষ করে কৈডাঙ্গা ব্রিজের প্রাণহানি ছিল বেশি। অনেক তদবিরের পর কাজটা হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য এই এলাকার বাসিন্দা আলহাজ্ব মকবুল হোসেনের অবদান রয়েছে। ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমির হোসেন বলেন, সেতুর সামনে ট্রেন যাবার সময় এলাকাবাসীকে নিয়ে মানববন্ধন করেছি। সেতুর দু’পাড়ে গ্রাম পুলিশ দিয়ে ট্রেন থামিয়ে সেতুর কাছে ছাদ থেকে যাত্রী নামিয়েছি। তিনি বলেন, কাজটি শেষ হলে প্রতি বছর শতাধিক ট্রেন যাত্রী দুর্ঘটনায় প্রাণহানি থেকে রক্ষা পাবে।

সর্বশেষে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি রাতে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের সময় চাঁপাইন্বাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তি ইউনিয়নের লহমমারী গ্রামের জিয়াউর রহমান, সাইদুর রহমান ও আব্দুল হানিফ নামের তিন হতভাগ্য কৈডাঙ্গা প্রাণনাশী রেলসেতুর খাঁচার ধাক্কায় নিহত হন। উল্লেখ্য, ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্রিজ দু’টি নির্মাণ করে। তখন কোন যাত্রী ছাদে ভ্রমণ করতো না। সময়ের প্রয়োজনে ঠিক একশ বছর পর অবকাঠামোর টপ উঁচু করার প্রয়োাজন দেখা দেয়।



মন্তব্য চালু নেই