কূটনীতিকদের তিন প্রস্তাব :

একটিতে রাজি খালেদা, হাসিনার জবাব নেই

দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট ও চলমান অস্থিরতা দূর করতে কূটনীতিকরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার সময় তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এর একটিতে খালেদা জিয়া সম্মতি দিলেও প্রধানমন্ত্রী জানার পর এখনো কোনো জবাব দেননি।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১৬ দেশের কূটনীতিকরা মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যে তিনটি প্রস্তাব দেন তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে— শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে সবগুলো দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকারের অধীন অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন। দ্বিতীয় প্রস্তাব— রাষ্ট্রপতির অধীনে সবগুলো দলের সমন্বয়ে ২০১৬ সালের প্রথমদিকে জাতীয় সরকারের অধীন অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন। তৃতীয় প্রস্তাবটি ছিল— জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে সংলাপ শুরুর নিশ্চয়তা।

জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কূটনীতিকদের দেওয়া প্রস্তাবের মধ্যে দ্বিতীয়টিতে সম্মতি জানিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রপতির অধীনে সবগুলো দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকারের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন— এই প্রস্তাব মেনে নেন। কূটনীতিকরা এ বার্তাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও পাঠিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এখনো কোনো জবাব দেননি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এমন পরিস্থিতিতে কূটনীতিকরা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর ওপর এখন সব নির্ভর করছে। প্রধানমন্ত্রীই পারেন বাংলাদেশকে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলতে।

কূটনীতিকদের তিনটি প্রস্তাবনা সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আহমেদ আযম  বলেন, দেশের মহাসঙ্কট নিরসনে কূটনীতিকরা যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে নজিরবিহীন হিসেবে দেখছি ও স্বাগত জানাই। আমি মনে করি, দলও স্বাগত জানাবে। প্রস্তাবনা সম্পর্কে আমি এই প্রথম আপনার কাছ থেকে জানলাম।

এ প্রস্তাবনাগুলো যদি ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) কূটনীতিকরা দিয়ে থাকেন, তাহলে তা অবশ্যই দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য দলের স্থায়ী কমিটির সকলকে নিয়ে বৈঠক করার সুযোগ দিতে হবে। পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলে দিতে হবে। খালেদা জিয়া দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে অতীতে যেমন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রস্তাবনা উনার কাছে পৌঁছে থাকলে এবারও তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, সংকট উত্তরণে সম্মানজনক সমঝোতার কৌশল নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ লক্ষ্যে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পর্দার অন্তরালে বিএনপির সঙ্গে চলছে নানান দেন-দরবার।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা দাবি করেন, খালেদা জিয়ার দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা না থাকতে পারে। জননেত্রী শেখ হাসিনার এ দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা আছে। যেভাবে পেট্রোলবোমা দিয়ে খালেদা জিয়া মানুষ মারছে, তাতে তো আর এটাকে আন্দোলন বলা যায় না। এ সব সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় শুভ উদ্যোগ নিবেন।

ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ মনে করছেন, তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে সংলাপ শুরু হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে চলমান সহিংসতার সমাধানের একটি রূপরেখা তৈরি হবে। এতেই আগাম নির্বাচনসহ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, নির্বাচনের সময় সবকিছু চূড়ান্ত হবে।

বিকল্প পথে বা তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে সমঝোতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ভাবছে কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা আপাতত ভাবছি না। বর্তমান সমস্যা আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভাবছে। ’

চলতি বছরের পাঁচ জানুয়ারির পর থেকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই নিজেদের অবস্থান সঠিক বলে দাবি করছে। উভয় দলই দাবি করছে, বিদেশীরাও তাদের পাশে রয়েছে এবং তাদের সমর্থন দিচ্ছে।

অন্যদিকে, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাংলাদেশে অবস্থিত সকল মিশন থেকে আনুষ্ঠানিক বার্তা দিয়ে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়তে এবং সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছে বিদেশীরা।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিদেশীরা শুধু বার্তা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখা, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের জন্য অনুরোধ করেছে। সরবকার এবং বিএনপিকে বিদেশীরা বার বার তাগাদা দিচ্ছে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে। সর্বশেষ পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইউরোপের সবগুলো মিশন এক হয়ে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দু’টি দলকেই একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, খালেদা জিয়ার মনোভাবের বার্তা কূটনীতিকদের মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানোর পর গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) নিজের কার্যালয়ে অবস্থান করে নাটুকেপনা করে জনগণ ও কূটনীতিকদের সিমপ্যাথি (সহানুভূতি) নিতে চাচ্ছেন। তিনি (খালেদা জিয়া) নিজেই চাচ্ছেন, তাকে গ্রেফতার করা হোক। বিদেশী সহানুভূতি চাচ্ছেন তিনি। জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য নাজিমউদ্দিন রোডকে বেশী নিরাপদ মনে করছেন।’

এদিকে, কূটনীতিকদের এই প্রস্তাবে সরকার সাড়া দিবে না বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীদের বক্তব্যেও তার প্রমাণ মিলেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত বুধবার জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার (ওএইচসিএইচআর) হাইকমিশনার জেইড রা’ড আল হুসেইনের সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর উন্নয়নসহ মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশে সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এই সহিংসতা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসআইএসের মতো।’

ওই একই দিন বুধবার বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে বিএনপির পক্ষে দলটির জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এশীয় (দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয়) বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে ২০ দলীয় জোটের অবস্থান এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক বিষয়ে বিভিন্ন নথিপত্র সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের হাতে তুলে দেন। ড. ওসমান ফারুক বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে চেয়ারপারসনের অবস্থান, তাকে নানাভাবে হয়রানিসহ সামগ্রিক বিষয়ে আমাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এশীয় বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার প্রমাণপত্র তার হাতে তুলে দিয়েছি।’

সদ্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল বিষয় হচ্ছে, বিদেশী বন্ধু বাড়ান। বিদেশীরা বাংলাদেশে অনেক বিনিয়োগ করছে, ব্যবসা করছে, বিভিন্নভাবে সহায়তাও করছে। তাই বিদেশীরা কোনো পরামর্শ দিলে তা সরকার বিবেচনা করবে।’

এদিকে, গত ৫৯ দিনের অবরোধে মোট ১১৪ জন নিহত (হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা, ক্রসফায়ার) হওয়ার তথ্য জানা গেছে। যার মধ্যে পেট্রোলবোমা ও আগুনে ৬১ জন, বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনিতে ৩৬ জন এবং সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ লাশ ও সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত হন। এ ছাড়া প্রায় ৭০০টি যানবাহনে আগুন এবং প্রায় ৬৫০টি যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই