একটি ভাষণের প্রতীক্ষায় সারা দেশ
বাঙালী জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় শুরু হয়েছিল প্রাণঘাতী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করে বীর বাঙালীরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি তাই নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে স্মরণ করছে দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
একাত্তরের এসব দিনের পরিস্থিতি ছিল এ রকম- একদিকে স্বাধীনতা ঠেকাতে রণপ্রস্তুতিতে পাকিস্তানি সামরিক হানাদাররা। অন্যদিকে যে কোন আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে অটুটবন্ধনে বীর বাঙালীরা। সভা, মিছিল, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে বাঙালী হত্যা- সব মিলিয়ে অগ্নিগর্ভ সময়, বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি।
একাত্তর সালের ৬ মার্চেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছিল হরতাল। সকাল ছ’টা থেকে দুপুর দু’টা পর্যন্ত। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন একাত্তরের এ দিন দুপুরে। তার ভাষণের পুরোটা জুড়েই ছিল বীর বাঙালীকে উদ্দেশে করে হুমকি ও ধমকি। ছিল পাকি সামরিক বাহিনী দিয়ে বাঙালীকে শায়েস্তা করার হুমকি।
‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত’- বেপরোয়া বাঙালী তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে যেমন উদ্দীপ্ত তেমনি ফুঁসছিল বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ও ঘৃণায়। পরদিন ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন বাঙালীর মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণে তিনি কী বলবেন? বহুল আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতার ঘোষণা তার বর্জকন্ঠে উচ্চারিত হবে কি? এ নিয়ে তখন জল্পনা-কল্পনার অন্ত ছিল না।
একাত্তরের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী ৭ মার্চ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের একদিন আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হুমকি-ধমকি স্বাধীনতাকামী বাঙালীকে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে তোলে। এমনিতেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন চলছে। পাকি প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর তা নতুন মাত্রা পায়।
বাঙালীর প্রবল আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা। কি ভাবে বাঙালীর এই আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা যায় সে ব্যাপারে নীলনকশা করতে থাকে সামরিক জান্তা ও তাদের এদেশিয় দোসররা। বিশ্বের কাছে স্বাধীনতার জন্য বাঙালীর এই বাঁধভাঙ্গা আন্দোলন-সংগ্রামের খবর যাতে কোনভাবেই যেতে না পারে সেজন্য তৎপর হয়ে উঠে পাকিস্তানি জেনারেলরা। শুধু সেন্সরশিপ আরোপই নয়, কোনভাবেই যাতে বাঙালীর আন্দোলন-সংগ্রামের খবর না ছাপা হয় সেজন্য প্রতিটি সংবাদপত্রের অফিসে ফোন বা সশরীরে গিয়ে হুমকি-ধমকিও দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৬ মার্চের হরতালও সারাদেশে সর্বাত্মকভাবে পালিত হয়। গত কয়েকদিনে সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ ক’দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন বেতারে ভাষণ দেন। ৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো ৫ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে খসড়া তৈরি করেছিলেন বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত হয়।
অন্যান্য ঘটনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কারাবন্দী পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়।
এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে তদস্থলে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে উভয় পদে নিযুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়।
এদিকে এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “পরিস্থিতি রক্ষা করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল শেখ মুজিবের বক্তৃতায় জানতে পারবেন।”
কার্যত, সারা দেশের মানুষ এদিন থেকে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবর্তী দিকনির্দেশনা জানার।
মন্তব্য চালু নেই