সাপের মুখে পড়েছে জামায়াত

রাজনীতির সাপ-লুডুর খেলায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মইয়ের বদলে বার বার সাপের মুখে পড়ছে। কারণ দলটি বার বার আদর্শ থেকে সরে এসে রাজনীতি করতে চেয়েছে। কিন্তু দলটির নেতারা রাজনীতিতে যে অগ্রহণযোগ্য, অযোগ্য তা তারা কখনো বুঝতে চাননি। কিছু সংখ্যক নেতারা অহংবোধ দলটিকে আজ কঠিন এক পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা পড়ে গেছেন সমাধানহীন এক সংকটে।

এমন সব প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন জামায়াতের একজন রোকন (ক্যাডারভিত্তিক দলটির সর্বো্চ্চ ধাপ)। তিনি সম্পাদক বরাবর লিখেছেন “আমি সাংবাদিক তো নই, তাই হয়তো সব কথা গুছিয়ে লেখা হয়নি। তবে যা লেখা হয়েছে তা সংগঠনের মাঠকর্মীদেরই মনের কথা।প্রকাশ করলে বাধিত হবো।”

তার লেখাটি এখানে তুলে ধরা হলো:

বৃটিশ শাসিত ভারতে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬শে আগস্ট । শুরুতে সংগঠনটির নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী দলটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৯ এবং ’৬৪ সালে পাকিস্তানে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দলটি ১৯৭৬ সালে ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ নামে বাংলাদেশের রাজনীতি শুরু করে। পরে দলটি ১৯৭৯ সালের ২৫ মে নিজ নামে স্বাধীন বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর দলটি নানা ঝড়ঝাপ্টা মোকাবিলা করলেও কখনও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়নি। ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ বিলুপ্ত করে জামায়াত প্রতিষ্ঠা করাই জামায়াত নেতাদের সবচেয়ে বড় ভুল- মনে করেন দলটির পরামর্শকদের অনেকে ।

জামায়াতের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা স্বীকার করেন, এমন চরম-অত্যাচার নির্যাতনের মোকাবেলা এরআগে কোনোদিন তাদের করতে হয়নি। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে তার সঠিক ও নিরপেক্ষ পর্যালোচনা দলটির উদ্যোগে কোনোদিন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। দলে যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে করতে চেয়েছেন, তাদের কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘বিভ্রান্ত’ ‘সুযোগ সন্ধানী’ ইত্যাদি অপপ্রচার চালানো হয়েছে শীর্ষ পর্যায় থেকে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে, কট্টরপন্থী শীর্ষ নেতাদের ভুলের খেসারত আজ তৃণমূল থেকে নিয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত সব পর্যায়ের নেতা কর্মীকে দিতে হচ্ছে। অবশ্য দলটির কট্টরপন্থী নেতারা মনে করেন, ‘ভুল সিদ্ধান্ত তারা কোনো দিন নেন না। কারণ স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে ইলহাম প্রাপ্ত হয়ে তারা দল পরিচালনা করেন।’

কর্মীদেরকে তারা ধৈর্যধারণের নসিয়ত করে বলেন, অত্যাচার নির্যাতন আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। দল যত বড় ও শক্তিশালী হবে তত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি তাদের হতে হবে।

তারা বুঝতে নারাজ দলের আকার-প্রকার ও শক্তির তুলনা তাদের বেশি কঠিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। অথচ আল্লাহ কারো ওপর তার সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি বোঝা চাপান না। যদি কখনো মনে হয়ে আল্লাহর কোনো প্রিয় বান্দা, দল, গোষ্ঠি বা জাতির ওপর সামর্থ্যরে চেয়ে কঠিন পরীক্ষা নেমে এসেছে, তখন কেন এমন হচ্ছে, তা পর্যালোচনা করা জরুরি।

জামায়াতে ইসলামীর এমন কঠিন সময় আসছে এবং কেন আসছে সেই ইঙ্গিত দিয়ে নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম মরহুম আব্বাস আলী খান ইন্তিকালের আগে ‘একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেন। প্রথমে নিবন্ধটি একটি মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৯৮ সালে মূল নিবন্ধটি সম্পাদনার নামে কাট-ছাঁট করে ‘ একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ: তার থেকে বাঁচার উপায়’ শিরোনামে জামায়াতের নিজস্ব প্রকাশণী থেকে বই আকারে প্রকাশ করা হয়।

এরপর বড় আকারের উদ্যোগ নেয়া হয়, ২০১০ সালের ৯ জুন ঢাকার একটি বেসরকারি ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যালোচনা করে একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে,’জামায়াত বর্তমানে ইমেজ সংকটে ভুগছে। ভবিষ্যতে এই অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে।’ এমন মন্তব্য করার পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নানসহ কয়েকজন সাবেক আমলা, বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্রশিবিরের সাবেক বেশ কয়েকজন সভাপতির উপস্থিতিতে একটি মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে যে বিষয়গুলো উঠে আসে তা হলো:

এক, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় জামায়াতের প্রথম সারির বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচারণা থাকায় সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয়ভিত্তিক ইমেজ তৈরি তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রায় চার দশক জামায়াতের বিরুদ্ধে এই প্রচারণা বন্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা আবার শুরু হয়েছে। এতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জামায়াতের ব্যাপারে একটি বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী বিষয়টি সামনে চলে আসায় এটি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় জামায়াতের রাজনৈতিক ইমেজ পুনরুদ্ধার বা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত কঠিন হবে।

দুই. দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে রয়েছে দুর্বলতা। তাদের কেউ কেউ বৃদ্ধ ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নতুন উদ্যমে দলকে এগিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।

তিন, জামায়াতের পরিবেশ রুদ্ধদ্বার ( রেজিমেন্টেড) ধরনের। এ জন্য ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন উদারপন্থী ব্যক্তিরা এই দলে প্রবেশ করতে পারে না। দলটিতে সৎ মানুষের অভাব না হলেও দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত ও দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। জামায়াতের বাইরে যেসব সৎ ও দক্ষ লোক রয়েছে, তারা যেকোনো পর্যায়ে জামায়াতে যোগ দিতে উৎসাহবোধ করে না।

চার. জামায়াতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা বর্তমানে আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এতে ভোটারের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

পাঁচ. রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে আধুনিক ধ্যান-ধারণার অভাব রয়েছে। সমস্যাসংকুল বাংলাদেশের বেশকিছু মৌলিক সমস্যা রয়েছে। সব দলই এসব বিষয়ে কোনো না কোনো বক্তব্য দিয়ে থাকে। এসব সমস্যার অগ্রাধিকার নির্ণয় করে জামায়াত উত্তম বিকল্প কোনো সমাধানের দিকনির্দেশনা জাতির সামনে পেশ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অসৎ নেতৃত্বের বিকল্প হিসেবে জামায়াতের নেতারা তাদের দলকে জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেননি।

ছয়. ভোটের রাজনীতিতে বর্তমানে যে কৌশল নেওয়া হয়, তা নিতে জামায়াতের বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

সাত. জামায়াত নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনার আলোকে নিজেদের উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে নিজেদের কর্মসূচি উপস্থাপনের জন্য যে ধরনের আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা ব্যবহারে জামায়াতের ব্যর্থতা রয়েছে।

আট. নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস না করেও কৌশলগত কারণে উদারনীতি অনুসরণ করে সমর্থনের পরিধি বৃদ্ধির দৃষ্টিভঙ্গি জামায়াতের নেই।

নয়. বর্তমানে বিএনপির ভঙ্গুর অবস্থার কারণে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির ঐক্য ভবিষ্যতে কতটা কার্যকর হবে তা বলা কঠিন। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিকল্প একটি রাজনৈতিক প্লাটফরম গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়।

এই বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে জানানো হলে তিনি শিবিরের সাবেক সভাপতি ও জামায়াতের তরুণ নেতৃত্বকে বলেন, মীর কাশেম আলী ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সুযোগ-সন্ধানী। তাদের কথায় যেন তারা কান না দেয়। যদিও তরুণ নেতাদের পাল্টা প্রশ্নের (সুযোগ সন্ধানী হলে দলে রেখেছেন কেন?) কোনো জবাব তিনি দেননি ।মাওলানা নিজামী তখন সাবেক আমির গোলাম আযমের কাছে এই বিষয়ে নালিশ করেন। মীর কাশেম আলীকে ডেকে অধ্যাপক গোলাম আযম ‘ দলবিরোধী’ কাজ থেকে তাকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।

সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান গ্রেফতার হওয়ার পরও আলাদা প্লাট ফরম গড়ে তোলার বিষযটি দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান গ্রেফতারের পর, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বরাবর একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিতও হয়েছিল।এতে তিনি বর্তমান নেতৃত্বকে বুঝাতে চেয়েছিলেন, জামায়াতে ইসলামী নামে এবং ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করা এখন সুদূর পরাহত। অনুরূপ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল সংগঠনের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের লেখা একটি নিবন্ধে। কিন্তু তাদের কোনো পরামর্শই কানে তুলেনি জামায়াত। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও বারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের লেখার প্রতিক্রিয়ায় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দীর্ঘ কলাম লিখে প্রশ্ন তুলেন, যারা কারাগারে আছেন, তাদের মুক্ত করতে আন্দোলন-সংগ্রাম করবে কারা?

‘পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে লেখা ওই চিঠিতে কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ৬০ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের বিশ্লেষণ করে দলের জন্য বেশকিছু নতুন কৌশল ও কর্মপন্থা প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি এই চিঠিতে বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘খুব নাজুক’ এবং জামায়াতের জন্য ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’ বলে উল্লেখ করে তা মোকাবিলায় তিনটি বিকল্প পথ দেখিয়েছেন, এগুলো হলো:

‘এক. যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব। (বর্তমানে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে।)

দুই. পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াতের সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনে থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে।

তিন. আমাদের যাদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা’ অভিযোগ আনা হচ্ছে, তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াব এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেব। অর্থাৎ একটা নিউ জেনারেশন জামায়াত হবে এটি।’

কামারুজ্জামান লিখেছেন, ‘আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় উপরোক্ত তিন অবস্থার প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।’

চিঠির এক জায়গায় কারাগারে আটক নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে কামারুজ্জামান বলেন, ‘নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমাদের অনেকের তো বয়সও হয়েছে। সরাসরি আন্দোলনে থাকলেই বা আমরা আর কতটা অবদান রাখতে পারব? সুতরাং সবাই মিলে দ্বিতীয় যে বিকল্পটির কথা উল্লেখ করেছি, তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে কাংখিত এবং যুক্তিযুক্ত।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।’

মুহাম্মদ কামারুজ্জামান আরো লিখেছেন, ‘যেভাবেই ইতিমধ্যেই মিডিয়া জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বানিয়ে ফেলেছে। যদি সরকারের বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী বিচারকার্য চলে, তাহলে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে দেশে বিদেশে চিহ্নিত হয়ে যাবে।’ তার মতে, জামায়াতের নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিচার করার পর জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ না করলেও জামায়াতের ভাবমর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষুন্ন হবে। দেশের ভেতরে-বাইরে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করবে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। জামায়াতের ভাব-মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

তিনি গঠনের নতুন রূপরেখা উপশিরোনামে, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে জামায়াতকে পেছন থেকে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে নতুন প্লাটফর্মে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন । তার মতে, সেই প্লাটফর্মকে রাজনৈতিকভাবে কেউ সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না। তিনি লিখেছেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই। বরং হেকমতের খাতিরে তেমন একটা কিছু করে হলেও নতুন আন্দোলন দাঁড় করানোর ঝুঁকি গ্রহণ করা উচিত।’

তার মতে, বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না, সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। ছায়া মন্ত্রিসভা কনসেপ্ট গ্রহণ করতে হবে। বিশিষ্ট নাগরিক, প্রবীণ আলেম ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিয়ে দলের একটি অভিভাবক পরিষদ থাকবে। তিনবারের বেশি কেউ কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জেলা সভাপতি থাকতে পারবে না। সব পদের ব্যবহার বাংলা পরিভাষায় হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনে প্রথমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে গতিশীল করতে হবে। যুব ও ছাত্রদের সহায়তায় ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি দল, প্রয়োজনে ক্লাব গঠন করতে হবে। অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক ও ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলতে হবে। সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে ঢোকাতে হবে।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আন্দোলন করে, তাদেরকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না। তার ভাষায় “ তারা ন্যায়বিচার” পাবেন না। তিনি লিখেছিলেন, ‘সহসা সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। আন্দোলন করে আমাদের মুক্ত করা হবে এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। আন্দোলন করলে সরকারের পতন ঘটার কোনো আশঙ্কাও নেই, পুরো মেয়াদ (২০০৮-২০১৪) পর্যন্তই সরকার ক্ষমতায় থাকবে।’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘জামায়াতের ওপর এবং জামায়াতের নেতা হিসেবে আমাদের ওপর সুস্পষ্ট জুলুম হচ্ছে। এ জন্য অনেকে দুঃখ প্রকাশ বা নিন্দা করলেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কার্যকরভাবে আমাদের তথা জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করবে না। …বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে যে নির্বাচন হবে তাতেও জামায়াত ভালো করতে পারবে এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না।’

কামারুজ্জামান লিখেছেন, ‘পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতা করার মতো অতি স্পর্শকাতর কোনো অভিযোগ নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন খুবই সম্ভাবনাময় আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ও স্পর্শকাতর অভিযোগ আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার পথে বড় বাধার সৃষ্টি করে আছে।’

স্বাধীনতার পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর জনগণকে ইসলাম বোঝার চেয়ে তাদের বেশি সময় কেটে ১৯৭১ বুঝাতে। অবশ্য দলটির কট্টরপন্থীরা একথা মানতে নারাজ। জবাবও তাদের কাছে তৈরি। তাও একটা নয়, কম করে হলেও নয় থেকে ১০টি জবাব দিয়ে দিবে পাঁচ মিনিটে।

যেমন: মিশরে তো ১৯৭১ নেই, ১৯৬৯ এ তো স্বাধীনতা বিরোধীতার প্রশ্ন ছিল না, তাহলে আবদুল মালেককে কেন হত্যা করা হয়েছে? তাদেরকে কে বুঝাবে এক দলের প্রতি আরেক দলের বিরোধিতাসমালোচনা থাকবে? অভিযোগ পাল্টা অভিযোগও থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তার সাথে স্বাধীনতা বিরোধীতার ঐতিহাসিক সত্য মিলিয়ে ফেলা এক নয়, বিষয়টিকে এভাবে দেখতে হবে। মেজর (অব.) আবদুল জলিল, প্রেসিডেন্ট জিয়ারউর রহমান, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে ‘রাজাকার’ কিংবা ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ বলা আর পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষের জামায়াত নেতাদেরকে বলা এক বিষয় নয়। জনমনে এর প্রভাবও এক রকম হয় না, কারণ সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করার ইতিহাসের জ্ঞান তাদের আছে।

আরেকটি সমস্যা দলটিকে আজ এই নাজুক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে।সেটি হলো দলের নেতাদের অনেকের অকল্পনীয় দুর্নীতি। তাদের অনেকে সংগঠনটিকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেন। এদের কারণে অনেক অযোগ্য-অসৎ ব্যক্তির প্রভাব বেড়েছে দলটিতে। প্রতিপদে এর খেসারত দিতে হচ্ছে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের।নতুন বার্তা



মন্তব্য চালু নেই