বিপর্যস্ত জনজীবন : বাড়ছে ক্ষোভ
এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা অবরোধ ও হরতালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
জীবিকার তাগিদে মানুষ রাস্তায় বের হলেও তাদের মনে পেট্রোলবোমা ও ককটেলের আশঙ্কা। এমন অবস্থায় বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজধানীর সাধারণ মানুষ। তাদের দাবি— দুই দলের জেদাজেদির কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
খিলগাঁও থেকে শুক্রবার লেগুনায় দৈনিক বাংলা মোড় আসার পথে যাত্রীদের মাঝে কথা ওঠে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের এক যাত্রী প্রথমেই আলাপের সূত্রপাত ঘটান। যাত্রীদের প্রায় ১০ মিনিটের কথোপকথনে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, শঙ্কা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে যাত্রীদের মধ্যে স্বপন নামে একজনের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদক। স্বপন বলেন, ‘এভাবে দুই দলের কাছে কতদিন জিম্মি হয়ে থাকব? জীবনের নিরাপত্তা নাই। রাস্তায় চলতে পারি না। ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষার সময়ও বিএনপি হরতাল-অবরোধ দেয়।’
মিনহাজ নামের আরেকজন যাত্রী বলে ওঠেন, ‘ভাই ওনাদের ছেলে-মেয়েরা তো বিদেশে লেখাপড়া করে। তাদের তো সমস্যা নেই। সমস্যা যত পাবলিকের।’
এ প্রতিবেদক বিকেলে মতিঝিল আসার উদ্দেশে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে উঠার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় মামুনুর রশীদ নামে এক জনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘দুই নেত্রীর জেদাজেদিতে দেশ আজ ছারখার হচ্ছে। তারা চাইলেই দেশটাতে শান্তি আসে। পেট্রোলবোমায় কারা মরছে? সব সাধারণ মানুষ। কই আওয়ামী লীগ-বিএনপির একজনও তো মরে না। দুই দল দেশটাকে বাপের তালুক মনে করে। আগে পাঁচ বছর পর ভোট দিতাম, এবার তাও পারলাম না। এরশাদকে স্বৈরাচার বলি, তার চেয়ে এরা কী কম?’
এ সময়ে লিটন নামে আরেকজন যুক্ত হন এ আলাপচারিতায়। তিনি বলেন, ‘কী দরকার ছিল খালেদা জিয়াকে আটকে (অবরুদ্ধ) রাখার? আবার তার অফিসে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট লাইন (সংযোগ) কেটে (বিচ্ছিন্ন) দেওয়া হয়েছিল। এখন আবার খাবার ঢুকতে দিচ্ছে না। এভাবে সরকার আরও সমস্যা বাড়াচ্ছে।’
নাম জানা যায়নি অন্য একজন লিটনের কথার রেশ ধরে বলেন, ‘কেউ কম নারে ভাই। সবাই আমাদের নিয়া রাজনীতি করে। খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনও দেখছি, তিনি বিরোধী দলকে ঠিকমতো কর্মসূচি পালন করতে দেয়নি। মনে হয়েছিল, তারাই (বিএনপি) সারাজীবন ক্ষমতায় থাকবে। শেখ হাসিনার মিটিংয়ে বোমা হামলার ঘটনা ঘটল।’
তিনি বলেন, ‘সমস্যার সমাধান প্রায় হয়েই গিয়েছিল। শেখ হাসিনা কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গেলেন। কিন্তু গেট খুলল না। গেটটা খুললে কী হতো? দুই নেত্রীর মধ্যে সেদিন কথা না হোক দুইজনের দেখা হতো। এতেও আলোচনার পরিবেশ ফিরে আসত। দেশের বুদ্ধিজীবীরা, বিদেশী কূটনীতিকরা সংলাপের কথা বললেও কেউ কারও কথা শুনছে না। সমস্যা সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখছি না।’
এ সময় লিটন বলেন, ‘সবসময় ভয়ে থাকি ভাই। এই কয়দিনে বহু মানুষের জান গেল। আর কত মানুষ মারা যাবে?’
রাজধানীর মতিঝিলে বেসরকারি একটি অফিসে চাকরি করেন রফিকুল ইসলাম। বাড়ি বগুড়ার সোনাতলায়। বনশ্রী এলাকায় তিনি মেসে থাকেন। স্ত্রী ও সন্তান থাকেন গ্রামে।
রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় মতিঝিলে। তিনি বলেন, “আগে মাসে কমপক্ষে দুইবার বাড়ি যেতাম। কিন্তু গত এক মাসেও বাড়ি যাওয়া হয়নি। বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বলেছেন, ‘দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থায় তোমার বাড়ি আসার দরকার নেই। রাস্তায় যে অবস্থা— যখন তখন বাসে বোমা পড়ছে, আগুন দিচ্ছে। দেশের অবস্থা একটু ভালো হোক। আর কিছুদিন পরেই না হয় আসো।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তাই এভাবে আর কতদিন? আমার মেয়ে প্রতিদিনই আবদার করে আমি যেন বাড়ি যাই। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হবে কবে? নেতারা কী আমাদের মানুষ ভাবে না?’
গাজীপুর-সদরঘাট রুটের সুপ্রভাত পরিবহনের চালক মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই প্রথম প্রথম রাস্তায় গাড়ি বের করতাম না। এখন মাঝে মাঝে গাড়ি চালাতে পারছি। কিন্তু এভাবে কতদিন। বউ পোলাপান তো আছে। পেট্রোলবোমা-আগুন-ককটেল সবকিছু উপেক্ষা করেই রাস্তায় বাস চালাই। তয় ভয়ে থাহি— কখন জানি একটা পড়ে।’
পল্টন থেকে রিকশায় দিলকুশা আসতে কথা হয় চালক আব্দুস সালামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি বলেন, ‘ভাই-হুনতাছি হাসিনা-খালেদার মধ্যে আলাপ অইব। সমস্যার সমাধান অইব। কবে অইবরে ভাই? আগে দিনে ৭০০-৮০০ ট্যাহা কামাই হরতাম। এখন ৪০০ টাকাও অয়না। এর মইদ্যে ১০০ টাকা মালিককে রিকশার জমা দিতে হয়। পাঁচজনের সংসার। খুব কষ্টে আছি ভাই।’
শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন ‘যে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই। তাই আমরা চলমান এ সংকট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নিতে সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি। বিশেষভাবে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে চলমান সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্য তৈরির লক্ষ্যে শামসুল হুদাকে আহ্বায়ক করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়।
এফবিসিসিআইসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠন বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সঙ্কট সমাধানের জন্য প্রধান দুই দলকে অনুরোধ জানিয়েছে। সুশীল সমাজ এবং বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জোটের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সঙ্কট সমাধানে আলোচনায় বসতে প্রধান দুই দলের প্রধানকে অনুরোধ করে আসছে। কিন্তু দুই জোট বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কেউই এ পথে হাঁটছেন না। বরং যে যার অবস্থানে আগের মতোই অনড়।
চলমান রাজনীতি প্রসঙ্গে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাধারণ মানুষ তাদের উপর যে ক্ষুব্ধ, তাদের জীবন যে চরম নিরাপত্তাহীনতায় কাটছে— এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো মোটেও ভাবে না।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সঙ্কট উত্তরণে আলোচনার বিকল্প নেই। আর আলোচনার জন্য তো আগে পরিবেশ লাগবে। এ পরিবেশ সৃষ্টি করার অধিকার বা দায়িত্ব আমাদের দুই নেত্রীর। দুই দলকেই একে অপরকে ছাড় দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সহিংসতার জন্য যারা দায়ী তাদেরকে দায় স্বীকার করতে হবে। জোটের প্রধান হিসেবে খালেদা জিয়া যদি বলেন যা হচ্ছে তা আমরা চাই না। যারা এ সব করছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে সরকারপক্ষকেও নিশ্চয়তা দিতে হবে অহিংস বা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাঁধা দেওয়া হবে না। মিথ্যা হয়রানি মামলা দেওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। বিএনপি ও তাদের জোট যদি গঠনতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায় তার সুযোগ দেওয়া হবে।
দুই নেত্রী যদি মানুষের প্রতি সংবেদশীল হন তাহলে পরস্পরকে ছাড় দেবেন এবং আলোচনার উদ্যোগ নেবেন মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, উভয়পক্ষ নিজেদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছেন। আমি মনে করি যে পক্ষ প্রথম ছাড় দেওয়ার পদক্ষেপ নেবে তারাই আগে মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পাবেন। দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই