জিরো না পুরো ৩৬০ ডিগ্রি
সিনেমা হলে ঢোকার আগে চায়ের স্টলে বসে আড্ডা দেয়ার সময় আগের শো শেষ করে বের হওয়া দুই যুবকের টুকরো কথোপকথন কানে এলো। -এই চরিত্রে মাহফুজের মত অভিনয় আর বাংলা সিনেমার আর কোন নায়ক অভিনয় করতে পারত? অপর যুবক প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বলল -শালা, বহুদিন পর একখান সিনেমা দেখলাম। ‘সিনেমা দেখলাম’ শব্দটা কানে লেগে রইল, ভাবনার সবটুকু রেশ ছেড়ে দিয়ে সিনেমা হলে ঢুকলাম। অমিত (মাহফুজ) বলে যাচ্ছে তার নিজের কথা, আর পিছনে অসাধারণ সব দৃশ্যকল্প। ছবি শুরুর দশ মিনিটেই ক্যামেরার মুন্সীয়ানা দেখে তৃপ্ত না হয়ে আর কী উপায়, যখন চারপাশে কেবল গতানুগতিক দৃশ্য। পুরো ছবি জুড়েই এই দক্ষতার ছোঁয়া স্পষ্ট। কাহিনীতে আলাদা দুইজনের প্রতারিত হওয়ার গল্পবুনে মানসিক হাসপাতালের বিছানা পর্যন্ত গিয়ে পরিচালক বিরতির পর কী ঘটবে তা জানতে দর্শকদের বেশ উদগ্রীবই করে রাখেন।
কাহিনীতে নীরা (রুহী) ছেড়ে চলে যায় সংসার, সন্তান। কিন্তু তার চলে যাওয়া অমিতের জীবনের এলোমেলো হওয়ার দৃশ্য এবং শুরু হয় সিনেমার প্রথম গান ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে!’ হ্যাঁ রবীন্দ্রসংগীতই বটে। বহু বহুদিন পর বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমায় রবিঠাকুর যেন সার্থকভাবে ফিরে এলেন। গানের দৃশ্যায়নেও পরিচালকের মুন্সীয়ানা চোখে পড়ার মত, বাগানবিলাসের ঝড়ে পড়া থেকে সিগারেটের ধোঁয়া সমস্তই যেন কাহিনীর প্রয়োজন মেনে উপস্থিত। ছবিতে মাহফুজ তার অভিনয়ের সবটুকুই যে ঢেলে দিয়েছেন তা বলা বাহুল্য। চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যুদৃশ্যের অংশটুকুতে মাহফুজ যেন সমস্ত দর্শককে স্তব্ধ করে দেন। আর এখন থেকে বাংলা সিনেমায় দুর্ঘটনার দৃশ্যায়ন কেমন হতে পারে তা এই দৃশ্য থেকে পুরনো সব পরিচালকেরা নতুন পরিচালক অনিমেষ আইচের কাছ থেকেও শিখে নিতে পারেন।
মাহফুজের মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কাহিনী শেষ না হতেই পর্দায় সোনিয়ার (জয়া) উপস্থিতি। তার কাহিনীতেও বুঁদ হয়ে যান হলভর্তি সব দর্শক। আর এই কাহিনীতে পরিচালক বুঝিয়েছেন অভিনেতাকে কিভাবে গড়ে নিতে হয়। তা না হলে সারাজীবন ধরে সিনেমায় ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করে যাওয়া বুড়ো টেলিসামাদ যে নাচের মাস্টারের চরিত্রে এভাবে মানিয়ে যাবেন তা কেউ কি ভাবতে পেরেছিলো! না একটা বাহুল্য দৃশ্য, না কাহিনীর সামান্য ছন্দপতন। টানটান কাহিনী আর টগবগে দৃশ্যায়নে ছবির প্রথমার্ধ এতটাই মুখর যে বিরতি যেন আর সহ্য হলো না দর্শকদের। সবাই শুরু করলো চিৎকার ছবি শুরু হোক, ছবি চালাও। বিরতির সময়ও পুরো হল ভর্তি, কেউ যেন সিট ছেড়ে উঠতে চাচ্ছে না। তাই বিরতিও হলো সংক্ষেপিত, শুরু হলো সিনেমা, ততক্ষণে আগের শোয়ের দুই দর্শকের কথোপকথনের ‘সিনেমা দেখলাম’ কথাটার মাজেজা বুঝতে শুরু করেছি।
সাধাসিধে অমিত আর বারবার প্রতারিত হওয়া সোনিয়া প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মুখ। তাদের প্রতিশোধ স্পৃহার সুতা বেয়ে দর্শকও যেন প্রতি মুহূর্তে রোমাঞ্চিত হতে থাকেন। তবে এই দ্বিতীয় অর্ধে পরিচালক দর্শকের কাছে বেশি ধৈর্য দাবি করে ফেলেছেন। ফলে কাহিনীর টানটান উত্তেজনায় কিছুটা হলেও ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এটুকু দোষের বাইরে কাহিনীর দৃশ্যায়নে এ অংশে যখন জেমসের ভরাট গলার গান শুরু হয় তখন দর্শকরা আবার এঁটে বসেন। কিংবা বোরকাওয়ালী সোনিয়া যখন নাচের মাস্টারকে খুন করার আগে ঢাকের বাজনার তালে নাচ শুরু করেন, তখন ওই বাজনার তাল পুরোটাই মুগ্ধ করে সবাইকে। কিংবা মাহফুজ যখন ভুল ‘নীরা’র কাছে গিয়ে তাকে খুন করে ফেলে তখন দর্শক ফের নড়েচড়ে বসেন। কাহিনীর ভাঁজে ভাঁজে এরকম নতুনত্ব প্রায় সারা সিনেমা জুড়েই দর্শকদের একের পর এক বিহ্বল করে গেছে।
শুন্য থেকেই নাকি সবকিছুর শুরু হয়। সেক্ষেত্রে ‘জিরো ডিগ্রি’ হয়ত বাংলা সিনেমার পট পরিবর্তনে নতুনভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে। সিনেমার দুর্দিনের আসল কারণ যে বস্তাপঁচা কাহিনী আর রদ্দিমার্কা অভিনয়, দৃশ্যায়ন তা চোখে আঙুল দিয়ে এই সিনেমা দেখিয়ে দিয়েছে। নামে জিরো ডিগ্রি হলেও দর্শক কোণের পুরো ৩৬০ ডিগ্রিই পরিচালক সার্থকতার সঙ্গে পূরণ করতে পেরেছেন। গতানুগতিক কাহিনী আর নকল দৃশ্যায়নে বিরক্ত বাংলা সিনেমার দর্শক যে ভালো কিছু পেলে সাদরে গ্রহন করতে প্রস্তুত তা এ সিনেমার আয়ের অঙ্ক দেখে নিশ্চয়ই সেইসব প্রযোজক ও পরিচালকের হুঁশ ফিরবে, যারা একের পর এক নকল কাহিনী আর দৃশ্য বানানোকেই সিনেমা মনে করেন। অনিমেষ আইচকে ঈর্ষা করে হলেও তারা হয়ত ভালো কাহিনী আর মৌলিক দৃশ্যায়নের কথা চিন্তা করবেন।
জিরো ডিগ্রি
কাহিনী, চিত্রনাট্য, পরিচালনা- অনিমেষ আইচ
প্রযোজক- মাহফুজ আহমেদ
চিত্রগ্রাহক- নেহাল কোরেশি।
অভিনয়ে- মাহফুজ আহমেদ, জয়া আহসান, দিলরুবা ইয়াসমিন রুহী, টেলি সামাদ প্রমুখ।
মন্তব্য চালু নেই