ফিরে দেখা : ষষ্ঠ বিশ্বকাপ শ্রীলঙ্কার ঘরে
বিশ্বকাপ নিয়ে মানুষের উন্মাদনার শেষ নেই। এক একটি বিশ্বকাপের জন্য মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে হয় দীর্ঘ চার চারটি বছর। বছর ঘুরে আবারও দুয়ারে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হতে যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের একাদশতম আসর। কিন্তু কেমন ছিল এর আগের ১০টি আসর? সেটা নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা থাকছে রাইজিংবিডিতে। ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ প্রকাশিত হচ্ছে ষষ্ঠ বিশ্বকাপের আদ্যোপান্ত।
ষষ্ঠ বিশ্বকাপে যা কিছু প্রথম :
প্রথমবারের মতো আইটিসি উইলস ব্র্যান্ড এই টুর্নামেন্টের পৃষ্ঠপোষক হয়।
প্রথমবারের মতো ১২টি দল অংশ নেয়।
প্রথমবারের মতো অংশ নেয় কেনিয়া, নেদারল্যান্ডস ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
প্রথমবারের মতো রঙিন পোশাক, সাদা বল ও ডে-নাইট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথমবারোর মতো কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা।
ষষ্ঠ বিশ্বকাপ, ১৯৯৬ :
ষষ্ঠবারের মতো ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপের আয়োজন করে আইসিসি। এই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ১২টি দেশ অংশ নিয়েছিল। প্রথম দল হিসেবে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অংশ নেয় কেনিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডস। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এই বিশ্বকাপ।
ষষ্ঠ বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছিল ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। তিনটি দেশের ২৬টি ভেন্যুতে রাউন্ড রবিন ও নকআউট পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয় এই বিশ্বকাপ। ২৬টি পৃথক ভেন্যুতে সর্বমোট ৩৭টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে গ্রুপ পর্বের ৩৪টি, দুটি সেমিফাইনাল এবং একটি ফাইনাল ম্যাচ ছিল।
প্রথমবারের মতো ‘আইটিসি উইলস’ ব্র্যান্ড এই বিশ্বকাপের পৃষ্ঠপোষক হয়। তাই তাদের নামানুসারে বিশ্বকাপের নামকরণ করা হয় ‘উইলস বিশ্বকাপ’। এই বিশ্বকাপেও ওভার সংখ্যা ছিল ৫০। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।
খেলার ফরম্যাট :
প্রতিটি ম্যাচের এক ইনিংসে ৫০ ওভার খেলা হয়। উভয় দলের খেলোয়াড়রা রঙিন পোশাক পরে মাঠে নামেন। ম্যাচে ব্যবহৃত হয় সাদা বল। এই বিশ্বকাপের বেশিরভাগ ম্যাচ দিনে অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য কিছু ম্যাচ ফ্ল্যাডলাইটের আলোয়ও (ডে-নাইট) অনুষ্ঠিত হয়।
১২টি দল দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাউন্ড-রবিন লিগ পদ্ধতিতে একে অপরের মুখোমুখি হয়। পয়েন্টের ভিত্তিতে দুটি গ্রুপের শীর্ষস্থানধারী চারটি দল কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। সেখানে নক-আউট পদ্ধতিতে লড়াই করে সেমিফাইনালে ওঠে চারটি দল। সেমিফাইনাল থেকে ফাইনালে ওঠে দুটি দল। ফাইনালের বিজয়ী দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
আয়োজক দেশ নিয়ে বিতর্ক :
১৯৯৬ বিশ্বকাপে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা যৌথভাবে স্বাগতিক দেশের মর্যাদা পায়। প্রতিযোগিতার কোনো খেলা আয়োজনের পূর্বেই বিতর্ক তুঙ্গে পৌঁছে। অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে তামিল টাইগার্স কর্তৃক শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বোমাবর্ষণের ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ দল দুটির জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘোষণা দেয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল কর্তৃপক্ষও দেশটিকে নিরাপদ বলে ঘোষণা দেয়। ব্যাপক আলোচনা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ নির্ধারিত খেলায় অংশ নেয়নি। ফলে, আইসিসি উভয় খেলায় শ্রীলঙ্কা দলকে বিজয়ী ঘোষণা করে। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দলটি কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
অংশগ্রহণকারী দল :
এই বিশ্বকাপে টেস্ট স্ট্যাটাসধারী সবগুলো দল অংশ নেয়। এ ছাড়া জিম্বাবুয়ে নবম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে অংশ নেয়। সহযোগী তিনটি দেশ নেদারল্যান্ডস, কেনিয়া ও আরব আমিরাত ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফির মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
গ্রুপ পর্ব :
‘এ’ গ্রুপে ছিল শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও কেনিয়া। ‘বি’ গ্রুপে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, পাাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডস।
‘এ’ গ্রুপ থেকে ৫ ম্যাচের ৫টিতেই জিতে পূর্ণ ১০ পয়েন্ট নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা। সমান ৬ পয়েন্ট নিয়ে ভারত ও অস্ট্রেলিয়াও কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে। ৪ পয়েন্ট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজও পায় শেষ আটের টিকিট। বাদ পড়ে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ে।
‘বি’ গ্রুপ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫ ম্যাচের ৫টিতেই জিতে পূর্ণ ১০ পয়েন্ট নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। ৮ পয়েন্ট নিয়ে পাকিস্তানও তাদের সঙ্গী হয়। যথাক্রমে ৬ ও ৪ পয়েন্ট নিয়ে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডও যায় কোয়ার্টার ফাইনালে।
কোয়ার্টার ফাইনাল :
৯ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম ও দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড-শ্রীলঙ্কা ও ভারত-পাকিস্তান। ইংল্যান্ডকে ৫ উইকেটে হারিয়ে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে ৩৯ রানে হারিয়ে ভারত সেমিফাইনালে ওঠে। ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৯ রানে হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে।
সেমিফাইনাল :
কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সেমিফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা, ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়া। ১১ মার্চ প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা ও ভারত। প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ২৫১ রান সংগ্রহ করে শ্রীলঙ্কা। ২৫২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ১২০ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে উপস্থিত ১ লাখ ১০ হাজার দর্শক মাঠে হাঙ্গামা শুরু করে। আগুন দেয়। খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য করে বোতল ছুড়ে। ফলে ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবার খেলা শুরু হলেও একই ঘটনা ঘটে। ফলে ম্যাচ রেফারি খেলা একেবারেই বন্ধ করে দেন এবং শ্রীলঙ্কাকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। ফলে প্রথমবারের মতো ফাইনালের টিকিট পায় শ্রীলঙ্কা।
১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ২০৭ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ৪৯.৩ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে ২০২ রানে করতে সক্ষম হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলে ৫ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পায় অস্ট্রেলিয়া।
ফাইনাল :
১৭ মার্চ লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে টস জিতে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে আমন্ত্রণ জানান শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুন রানাতুঙ্গা। প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৪ রানের ইনিংস খেলেন মার্ক টেলর। রিকি পটিংয়ের ব্যাট থেকে আসে ৪৫ রান। বল হাতে শ্রীলঙ্কার অরবিন্দ ডি সিলভা ৩ উইকেট নেন।
২৪২ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ২৩ রানেই দুই উইকেট হারিয়ে বসে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু তৃতীয় উইকেট জুটিতে গুরু সিনহা ও অরবিন্দ ডি সিলভা মিলে ১২৫ রান তোলেন। ১৪৮ রানে গুরুসিনহা (৬৫) আউট হলেও ডি সিলভা ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। তিনি অপরাজিত থাকেন ১০৭ রানে। সঙ্গে অর্জুন রানাতুঙ্গা অপরাজিত থাকেন ৪৭ রানে।
বল হাতে ৩ উইকেট ও ব্যাট হাতে অপরাজিত ১০৭ রান করে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন অরবিন্দ ডি সিলভা। টুর্নামেন্ট সেরা নির্বাচিত হন সনাৎ জয়সুরিয়া।
এক নজরে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ:
আয়োজক : ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা।
তারিখ : ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ, ১৯৯৬
টুর্নামেন্ট ফরম্যাট : রাউন্ড রবিন ও নকআউট
অংশগ্রহণকারী দেশ : ১২টি
মোট ম্যাচ : ৩৭টি
চ্যাম্পিয়ন : শ্রীলঙ্কা
রানার্স আপ : অস্ট্রেলিয়া
সবচেয়ে বেশি রান : ভারতের শচীন টেন্ডুলকার (৫২৩)
সবচেয়ে বেশি উইকেট : ভারতের অনিল কুম্বলে (১৫)
সিরিজ সেরা : সনাৎ জয়সুরিয়া (শ্রীলঙ্কা)
মন্তব্য চালু নেই