পুলিশের ‘রাজনৈতিক বক্তব্যে’ বাড়ছে সমালোচনা

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট সহিংসতা মোকাবিলায় রাজনীতিবিদের নানামুখী মন্তব্য সংসদ ও সংসদের বাইরে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে পুলিশ ও বিজিবি প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্যে সমালোচনা হচ্ছে।

জাসদের কার্যকরী সভাপতি মাঈনউদ্দিন খান বাদল এমপি, সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীসহ কেউ কেউ ‘বুকে’ গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মন্তব্য করেছেন। সমান্তরালে এ সব বিষয়ে মন্তব্য করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক, পুলিশের আইজি, র‌্যাবের ডিজিসহ আরও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা।

সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের (২) অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’

চলমান সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলে সমালোচনার জন্ম দেন। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ মন্তব্য করেছেন ‘হা-ডু-ডু খেলার জন্য অস্ত্র দেয়া হয়নি।’

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, আমি কোনো মন্তব্য করব না।

একাধিক বাহিনী প্রধানের এ সব বক্তব্যে সচিবালয় থেকে শুরু করে চায়ের দোকান ও আড্ডাস্থলে সমালোচনা হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংক্রান্ত বিষয় হওয়ায় কেউই নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না।

এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির অগ্রভাগে ছিলেন এবং বর্তমানে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য সমীচীন নয়। এ বিষয়টা মনে রেখে কাজ করা তাদের জন্যই ভাল।’

গত ১৬ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘আপনারা সোচ্চার হোন। আপনাদের সঙ্গে পুলিশ আছে, ভাল লোকদের দিয়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন।’

আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে জনসমাবেশের আদলে করা ওই মতবিনিময় সভায় এ সব মন্তব্য করেন তিনি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি।

একই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালের মতো আবারও একটি গোষ্ঠী শান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই গণশত্রুদের সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করা দরকার। এর জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

ওই দিনের অনুষ্ঠানের পর অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র আলোচনা ছিল পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ‘রাজনৈতিক’ বক্তৃতার বিষয়টি। ফেসবুক ব্যবহারকারী সায়েম সাবু মন্তব্য করেন— ‘এবার হত্যার আইনি প্রতিশোধ নেয়া হবে-র‌্যাব ডিজি। জনাব, তাহলে এতদিন যেগুলো গেল সেগুলো কি বেআইনি প্রতিশোধ।’

২৫ জানুয়ারি খুলনায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বেনজীর আহমেদ মন্তব্য করেন— ‘অপরাধীরা অপরাধ করবে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা চেয়ে চেয়ে দেখবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কি অস্ত্র দেওয়া হয়েছে হা-ডু-ডু খেলার জন্য?’ এ সময় তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ‘সস্তা প্রচার’ বলে অভিহিত করেন। এ দিন নাশকতার জন্য তিনি বিএনপিকে দায়ী করে কথা বলেন।

৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় এক মতবিনিময় সভায় বেনজীর আহমেদ নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে ‘আইনি প্রতিশোধ’ নেওয়ার কথা বলেন। একই সঙ্গে বলেন, ‘খুন করে ক্ষমতায় যাবেন? শ্যাইম, শ্যাইম।’ তবে এ দিন কোনো রাজনৈতিক দলের নাম বলেননি তিনি।

একই দিন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেন, ‘একটি লাশ পড়লে এর পরিবর্তে দুটি লাশ ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে।’ তার করা এ মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্ষমতার বিষয়ে বলেছি। লাশ তো আর ফেলিনি। নাশকতাকারীদের ভয় দেখানোর জন্য মন্তব্য করতে হয়।’

৩ জানুয়ারি রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বাস মালিক সমিতির নেতাদের বৈঠকে তিনজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে চলমান নাশকতার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে আইজিপি শহীদুল হক মন্তব্য করেন, ‘সন্ত্রাসীর কাছে সরকার হার মানবে না। সরকার যদি এদের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। এরপর আওয়ামী লীগ এসে একই কাজ করবে।’

ওই বৈঠকে তিনি আরও বলেন, ‘মহাসড়কে কোনো ঘটনা ঘটলে ওই এলাকার বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের আসামি করতে হবে।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেন গত ৩ জানুয়ারি। এর আগে গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের কয়েকজন এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

২৯ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে উপস্থিত পাঁচ মন্ত্রীর সামনে সাংবাদিকরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করলে একাধিক বিষয়ে আইজিপির স্বপ্রণোদিত মন্তব্য অনেকের নজর কেড়েছে।

এ সব বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়ার জন্য মোবাইল ফোন ও ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি পুলিশ প্রধানের। পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মোবাইলে সংযোগ পাওয়ার চেষ্টা করার পরামর্শ দেন।

র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদের মোবাইলে পাঠানো ক্ষুদে বার্তার জবাবে বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে র‌্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইং) কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এই প্রতিবেদককে টেলিফোন করে বলেন, ‘ডিজি মহোদয় ব্যক্তিগতভাবে কোনো সাংবাদিকের কাছে মন্তব্য করেন না।’ কিছু জানার থাকলে ডিজির উপস্থিত থাকা কোনো ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করে উত্তর নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই