সফলতার লক্ষ্যেই ২০ দলের টানা কর্মসূচি
টানা এক মাস কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যাওয়াকে আন্দোলনের অন্যতম অর্জন হিসেবে দেখছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভেদ ভুলে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সুদৃঢ় ঐক্য। আন্দোলনের মূল দাবির প্রতি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর জোরাল চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান সংকট নিরসনে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত রেখেছে জাতিসংঘ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সংলাপে বসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোকে চলমান আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য বলে দাবি করেছেন বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক।
তাদের ধারণা, আন্দোলনের কারণেই এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া এবং ১৯ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ দিতে সরকার বাধ্য হয়েছে। একইভাবে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ আরও বাড়ানো সম্ভব হলে আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা আসবে বলে একরকম নিশ্চিত জোটের নীতিনির্ধারকরা। তবে চলমান আন্দোলনে পেট্রলবোমার নৃশংসতাসহ বিভিন্ন সহিংসতা ও নাশকতায় কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন তারা। এসব সহিংসতার দায় নেবে না ২০ দলীয় জোট।
সূত্র জানায়, এক মাসের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে দলের হাইকমান্ডে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। আন্দোলনের চলমান ধারা আর কয়েক দিন অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে সরকার নানামুখী চাপের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হবেন- এমনটাই আশা তাদের। আন্দোলনে নেতাকর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে এসব সফলতাকে সামনে এনে তৃণমূলে বার্তা পাঠানো হচ্ছে। আরেকটু চালিয়ে যেতে পারলেই চূড়ান্ত ফল আসবে বলে এই বার্তার মাধ্যমে আশ্বস্ত করা হয় বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘ এক মাসের আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না এলেও বেশ কিছু ইতিবাচক অর্জন রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নেতাকর্মীদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য। প্রথমে সরকার আন্দোলনকে গায়ে লাগায়নি। বিএনপি কিসের আন্দোলন করবে এমনটা বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কি। ঢাকা থেকে সারা দেশ বিচ্ছিন্ন। সরকারের জন্য এটা খুবই অস্বস্তিকর। শোনা যাচ্ছে, আন্দোলনের চাপে তারা কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করেছে। এভাবে চালিয়ে যেতে পারলে দ্রুত একটা ইতিবাচক ফল আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অতীতে দলের মধ্যে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি থাকলেও আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সবাই একই প্ল্যাট ফরমে এসেছেন। এই মুহূর্তে দলের চেয়ারপারসন সরাসরি নির্দেশনা দিতে না পারলেও নেতাকর্মীদের ঐক্যের কারণেই দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। সরকার যেভাবে ধরপাকড়, মামলা-হামলা করছে তারপরও নেতাকর্মীদের মনোবলে চিড় ধরেনি। তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এজন্য তারা আরও বেশি স্বক্রিয় ও উদ্দীপ্ত হচ্ছেন। কারণ তারা জানেন, আন্দোলনে ছাড় দিলে সরকার তাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে।
হাফিজ বলেন, এর বাইরেও আন্দোলনে প্রাথমিক যে সফলতা চোখে পড়ার মতো সেগুলো হচ্ছে- তাদের দাবির প্রতি দেশী-বিদেশী সমর্থন। জাতিসংঘসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে। সরকারকে আলোচনায় বসতে দেশী-বিদেশী শক্তিগুলো চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তবে, চলমান আন্দোলনে সহিংসতা বিশেষ করে পেট্রলবোমায় সাধারণ মানুষের নিহত হওয়ার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটা কারা করে বলা মুশকিল। কিছু দুর্বৃত্ত এসব করছে। এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় পক্ষ সব সময় সুযোগ নিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে বিএনপি জোটের ওপর দায় চাপালে তো হবে না। কারণ অনেক জায়গায় সরকারি দলের লোকজনও এসব ঘটনায় আটক হচ্ছেন। বিএনপি মানুষ হত্যার রাজনীতি করে না বলেও দাবি করেন তিনি।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ পালন করে আসছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। আন্দোলনকে বেগবান করতে অবরোধের সঙ্গে মাঝে মাঝে যুক্ত করা হয় হরতালও। বর্তমানে সারা দেশে চলছে টানা হরতাল। এছাড়া প্রায় প্রতি দিনই দেশের কোনো না কোনো জেলায় স্থানীয়ভাবে হরতাল পালিত হয়। কোনো কিছুতেই কর্মসূচি থেকে বিরত থাকেনি তারা। ছুটির দিন এমনকি বিশ্ব ইজতেমার মধ্যেও অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। ছাড় দেয়নি পাবলিক পরীক্ষাকেও। সোমবার থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আগের দিন থেকে টানা ৭২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেয়া হয়। কর্মসূচি শেষ না হতেই মঙ্গলবার তা ৩৬ ঘণ্টা বাড়িয়ে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত করা হয়। বিগত সময়ে শুক্রবার হরতাল দেয়া হলেও পরীক্ষা চলাকালে তা হয়নি। এবার এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে শুক্রবার নির্ধারণ করায় ওই দিনও হরতাল দেয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে জোটের।
বিএনপি নেতাদের মতে, দাবি আদায়ে প্রথম থেকেই সরকারকে নানামুখী চাপে রাখার কৌশল নেয়া হয়। আন্দোলনের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ জোরাল করার প্রচেষ্টা শুরু করে। ক্ষমতাসীনদের অনঢ় অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও এক মাস পর তাদের প্রচেষ্টা অনেকটা সফল হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারতের বর্তমান মোদি সরকারের সরাসরি সহযোগিতার চেয়ে বাংলাদেশ ইস্যুতে দেশটির নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা ছিল বিএনপির। তাদের দৃষ্টিতে সে প্রত্যাশার প্রতিফলন হচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির পররাষ্ট্র নীতির কিছু পরিবর্তনকে বিএনপি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা দেশ-বিদেশে অবস্থান করে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফল হয়েছেন বলে দাবি ২০ দলীয় জোট নেতাদের। নির্বাচনের আগে গত সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না পেলেও ওই নির্বাচনকে দেশ-বিদেশে বিতর্কিত করা সম্ভব হয়েছে। এই বিষয়কেও তারা ওই সময়ের আন্দোলনের বিজয় হিসেবে দেখছেন। নির্বাচনের পর গত এক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক মহল ওই নির্বাচন নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছে। আর সংলাপের তাগিদ দিয়ে আসছে তারা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা বুঝি না দেশ এখন বার্নিং। দেশের সার্বিক চিত্র ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। দ্রুত আলোচনায় না বসলে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকার দমন-পীড়ন করে আন্দোলন দাবিয়ে রাখার যে কৌশল নিয়েছে তাতে দেশ আরও খারাপের দিকেই যাবে। কারণ, আন্দোলন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে সরে আসার কোনো উপায় নেই। একমাত্র আলোচনাই পারে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে।
পেট্রলবোমাসহ চলমান নাশকতা সম্পর্কে মাহবুব বলেন, এজন্য সবাই দায়ী। ঢালাওভাবে কোনো দলের ওপর দোষ না দিয়ে সরকারের উচিত হবে এই নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা।-যুগান্তর।
মন্তব্য চালু নেই