‘সুলতান সোলেমান’ নিয়ে এত ভয় কেন? এটাই কি নেপথ্য কারণ?

বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের মালিক ও শিল্পী-কলাকুশলীদের আন্দোলনের মুখে ভারতের টেলিভিশনে বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, বাংলাদেশী পণ্যের বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন ভারতের টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে। ফলে দেশের টেলিভিশনগুলোর আয় কমে গেছে এবং এতে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। ভারতের চ্যানেলগুলো যেভাবে বাংলাদেশের টেলিভিশনের মালিক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের ‘পেটে লাথি মারা’র আয়োজন করেছে, তাতে এই আন্দোলন করা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর ছিল না। পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা। টেলিভিশনের মালিক, শিল্পী-কলাকুশলীরা সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে বিদেশী চ্যানেলে এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। বিজ্ঞাপন প্রচারের সাথে জড়িত থাকলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে। সরকার দ্রুততার সাথে এই পদক্ষেপ নিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

দুর্ভাগ্যজনক দিক হলো, ভারতীয় টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের বাণিজ্যের সাথে দেশের আরেকটি টেলিভিশন, চ্যানেল আইয়ের মালিকরা জড়িত ছিলেন। এটিএন বাংলা এবং এটিএন নিউজের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান প্রকাশ্য সভায় ওই চ্যানেল মালিককে ‘নব্য সাংস্কৃতিক রাজাকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মাহফুজুর রহমান ও একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী মোজাম্মেল বাবুর বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছিলেন চ্যানেল আইয়ের মালিক ফরিদুর রেজা সাগর। এসব খবর দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা সফল হয়েছেন। ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের মালিক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরপর সবাই মিলমিশ হয়ে গেছেন। মানহানির মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এই আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নতুন কিছু বিষয় জানতে ও বুঝতে পেরেছে। প্রথমত, এ দেশের শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মীরা চাইলে যেকোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে দ্রুত বাধ্য করতে পারেন। সরকারের কাছে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আবার দেশের স্বার্থ এবং সংস্কৃতিবিরোধী কাজের সাথেও এ দেশের গণমাধ্যমের মালিক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের কেউ কেউ জড়িত রয়েছেন। মনে রাখতে হবে, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মালিক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা একজোট হয়েছিলেন বিজ্ঞাপন বাবদ তাদের আয় কমে যাওয়ার কারণে। বাংলাদেশে প্রচারিত ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ তেমন সোচ্চার নয়। হিন্দি ও কলকাতার বাংলা চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিরোধী নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে যাচ্ছে। তা নিয়ে তাদের জোরালো কোনো বক্তব্য রাখতে দেখা যায় না। অবশ্য কয়েকজন মিনমিনে সুরে হিন্দি সিরিয়ালগুলো বন্ধ করার কথা বলেছেন। কলকাতা থেকে প্রচারিত বাংলা টেলিভিশনের সিরিয়ালগুলোর ব্যাপারেও তারা নিশ্চুপ। অথচ এসব সিরিয়ালের দর্শক কম নয়। এসব সিরিয়ালের বিষয়বস্তু যেহেতু সংসারের নানা ধরনের টানাপড়েন ও কুটনামিকে কেন্দ্র করে, ফলে শুধু শহরে নয় গ্রামেও এগুলোর বহু দর্শক রয়েছে। পরকীয়াসহ পারিবারিক

নানা ধরনের অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত সম্পর্ক এসব সিরিয়ালের মূল উপজীব্য। এসব সিরিয়াল দেখাকে কেন্দ্র করে এবং এগুলোর প্রভাবে দেশে আত্মহত্যা ও খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।

বাংলাদেশের টেলিভিশন মালিকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় যেন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান দেখা যায়। এ নিয়ে তারা ভারতের কর্তৃপক্ষের সাথে বহু দেনদরবার করেছেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল দেখাতে নাকি কলকাতার ক্যাবল অপারেটররা তেমন আগ্রহী নয়। আবার এসব চ্যানেল দেখানোর বিনিময়ে যে অস্বাভাবিক ফি ধার্য করা হয় তা বাংলাদেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এ নিয়ে অনুনয়-নিবেদন ছাড়া বাংলাদেশের শিল্পী সমাজের আর কোনো কিছু যেন করার নেই।

তবে তাদের সব ক্ষোভ এখন দেশের টেলিভিশনগুলোতে বিদেশী ডাবিং করা অনুষ্ঠানের ওপর গিয়ে পড়ছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে বিদেশী কয়েকটি সিরিয়াল ডাবিং করে প্রচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে দীপ্ত টেলিভিশনে তুর্কি ভাষা থেকে ডাবিংকৃত সুলতান সুলেমান, মাছরাঙা টেলিভিশনে সোর্ড অব টিপু সুলতান এবং এস এ টেলিভিশনে ইরানি সিনেমা ইউসুফ-জুলেখা। এর মধ্যে ‘সুলতান সুলেমান’ অভাবনীয় দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

শিল্পী-কলাকুশলীদের কেউ কেউ দাবি করছেন, ডাবিং করা বিদেশী এসব অনুষ্ঠানের কারণে দর্শকেরা আর দেশের নাটক দেখছেন না। তারা বিদেশী সিরিয়ালগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে দেশী শিল্পী ও কুশলীদের কাজের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। বিশাল বাজেটের জৌলুশপূর্ণ এসব অনুষ্ঠান দর্শকদের সহজেই আকৃষ্ট করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কি নিছক জৌলুশপূর্ণ অনুষ্ঠানের কারণে দর্শকেরা এসব দেখছে। হুমায়ূন আহমেদের নাটক তো জৌলুশপূর্ণ ছিল না তারপরও এখনও কেন মানুষ বারবার দেখে? হানিফ সঙ্কেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তো খুব জৌলুশপূর্ণ অনুষ্ঠান নয়। এখনো ইত্যাদি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশী এসব ড্রামা সিরিয়ালের কাহিনী, সংলাপ এ দেশে কেন জনপ্রিয় হচ্ছে তার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। তাহলে এ দেশেও জৌলুশ ছাড়াই অনেক ভালো নাটক বা ড্রামা সিরিয়াল বানানো সম্ভব হবে।

বলিউডের হিন্দি এবং কলকাতার টেলিভিশনের বাংলা সিরিয়ালগুলোর সাথে, ডাবিং করা এসব সিরিয়ালের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সুলতান সুলেমানের জীবননির্ভর ড্রামা সিরিয়াল নিয়ে তুরস্কেও নানা বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, সুলতান সুলেমানকে যেভাবে এই সিরিয়ালে তুলে ধরা হয়েছে, তার সাথে বাস্তবের মিল নেই। বিশেষ করে হারেম নিয়ে যে বর্ণনা এসেছে তাতে তুরস্কে আপত্তি আছে। তুরস্কের পার্লামেন্টে এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইতিহাসের নানা ধরনের বিকৃতির অভিযোগ সত্ত্বেও শুধু তুরস্ক নয়, বিশ্বজুড়ে এই ড্রামা সিরিজটি নন্দিত। ৪৫টি ভাষায় প্রচারিত হয়েছে এটি। কেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে সুলতান সুলেমান জনপ্রিয় হলো? বাংলাদেশের কিছু শিল্পীর বক্তব্য, সুলতান সুলেমানের রাজপ্রাসাদের জৌলুশপূর্ণ দৃশ্য কিংবা পোশাকের কারণে এই সিরিয়াল জনপ্রিয় হয়েছে। আসলে কি তাই? এর কাহিনী বা সংলাপ কি মানুষকে আগ্রহী করেনি?

দীপ্ত টেলিভিশনে সুলতান সুলেমান প্রচারের আগে তুরস্কের অটোম্যান সুলতান সুলেমানের নামের সাথে এ দেশের খুব কম মানুষের পরিচয় ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, সুলতান সুলেমান এখন একটি আবেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, মানুষ বীরত্বের কাহিনী জানতে চায়। এ কারণে শুধু সুলতান সুলেমান নয়, ভারতে নির্মিত সোর্ড অব টিপু সুলতানও জনিপ্রয় হয়েছিল। এর সাথে যদি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি এবং ধর্মের মানানসই প্রভাব থাকে অবশ্যই সে ধরনের নাটক বা সিনেমা মানুষকে টানবে। হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলোর পর খুব কম নাটকেই এ দেশের মানুষের জীবনের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। ১৮ বছরের বালক-বালিকার প্রেমের ‘প্যানপ্যানানি’ নির্ভর নাটক নিশ্চয়ই সুলতান সুলেমানের কাহিনীর মতো জনিপ্রয় হবে না।

বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ধর্মের প্রগাঢ় প্রভাব রয়েছে। এমন কোনো পরিবার নেই, যে পরিবারে তরুণেরা না হোক, মধ্যবয়স্ক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নামাজ পড়েন না। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো নাটকে নামাজের দৃশ্য চোখে পড়া বিরল ঘটনা। শুধু নামাজ নয়, বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব আরবি ফারসি তুর্কি শব্দ ব্যবহার করে থাকে, টেলিভিশন নাটকের সংলাপে খুব সযতেœ এসব শব্দ পরিহার করা হয়। বাংলাদেশের টিভি নাটকে রাজাকার, নারী লোভী ও ভিলেনের চরিত্রে অনিবার্যভাবে আমরা দাড়ি, টুপি পরা লোকের উপস্থিতি দেখতে পাই। বাংলাদেশে খুব কম পরিবার এমন পাবো যে পরিবারে দাড়ি বা টুপি পরা লোক নেই। এসব দৃশ্য এ দেশের মানুষের ভাবনার জগতে কী প্রভাব ফেলে, তা আমাদের নাট্যকার ও শিল্পীদের মনে কখনো প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের মানুষের জীবন যাপন এক রকম, আর আমাদের শিল্পীদের জীবন আর ভাবনার জগৎ অন্য রকম। ফলে এ দেশের মানুষের জীবনের তেমন প্রতিচ্ছবি কোনো নাটকে থাকে না। ‘খেয়ে না খেয়ে’ ধর্মের প্রভাব আছে, এমন কিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নাম যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে কথিত প্রগতিশীলতা। অথচ সংস্কৃতির প্রধান উৎস হচ্ছে ধর্ম।

দীপ্ত টেলিভিশনে যখন সুলতান সুলেমান প্রচারিত হয়, এর আগে ও পরে ভারতীয় স্টার জলসার সিরিয়ালগুলোর অনুকরণে পারিবারিক কুটনামিকে কেন্দ্র করে পালকি ও অপরাজিতা নামে দু’টি সিরিয়াল প্রচার করেছিল এই চ্যানেলটি। সম্ভবত সুলতান সুলেমানের সিরিয়ালের সাথে ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ থেকে এগুলো প্রচার করা হয়েছিল; কিন্তু ওইসব সিরিয়াল দীপ্ত টিভির সুপার ফ্লপ প্রোগ্রাম হিসেবে পরিচিত। এই সিরিয়ালগুলোর তুলনামূলক দর্শকপ্রিয়তা থেকে আমাদের শিল্পী-নাট্যকাররা আশা করি, এ দেশের মানুষের ভাবনার জগৎ সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারবেন।

সুলতান সুলেমানের মতো বর্ণাঢ্য চরিত্রের নায়ক হয়তো আমাদের ইতিহাসে নেই। কিন্তু ইতিহাসে কি আমাদের কোনো নায়ক নেই? ঈশা খাঁ কিংবা নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন নিয়ে আমাদের লেখক-নাট্যকার, নির্মাতারা এরকম একটি সিরিয়াল বানানোর কোনো উদ্যোগ কেন নিতে পারেন না? টিপু সুলতান নেই, কিন্তু আমাদের তো তিতুমীর আছেন। তিতুমীরের সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে তো ২০-৫০ বা ১০০ পর্বের সিরিয়াল হতে পারে। কিংবা হতে পারে লায়ন অব ডেজার্টের মতো অবিস্মরণীয় কোনো মুভি। নির্মাতাদের কাছ থেকে সে রকম কোনো আগ্রহের কথা আমরা শুনিনি। এসব চরিত্রে কি মুসলিম সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যাবে বলে তারা আগ্রহী হতে পারছেন না? কিন্তু এটাই তো বাংলাদেশ। সুলতান সুলেমান কিংবা সোর্ড অব টিপু সুলতান কেন এ দেশের মানুষের কাছে এত জনপ্রিয়, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে আমাদের লেখক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও শিল্পীরা হয়তো বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষা ও জীবন জগৎ উপলব্ধি করতে পারবেন। -অন্যদিগন্ত।



মন্তব্য চালু নেই