দুই মিনিটের দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ

‘সাতাশি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই উপমহাদেশে নতুন একটি জাতি সৃষ্টি করেছিলেন, মুক্তির মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এবং এই প্রতিজ্ঞায় উৎসর্গ হয়ে যে, সব মানুষ সমান।

এখন আমরা এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি, এত সমৃদ্ধ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই জাতি কিংবা অন্য যেকোনো জাতি এটি দীর্ঘকাল সহ্য করতে পারে কি না সেই পরীক্ষায় ফেলে। আমাদেরকে এই যুদ্ধের একটি বিশাল ময়দানে মুখোমুখী দাঁড় করানো হয়েছে। আমরা এই ময়দানের একটি অংশ তাদের শয়নের জন্য উৎসর্গ করেছি যারা এজন্য জীবন দিয়েছিলেন যেন এই জাতি বাঁচতে পারে। এটি খুবই যুক্তিসঙ্গত ও সঠিক যে, আমরা তা করব।

তবে, বৃহৎ দৃষ্টিতে, এই ভূমিকে – আমরা উৎসর্গ করতে পারি না- আমরা নিবেদন করতে পারি না- আমরা পবিত্র করতে পারি না। সাহসী মানুষগুলো, জীবিত কিংবা মৃত, যারা এখানে যুদ্ধ করেছেন, এই ভূমিকে পবিত্র করেছেন, আমাদের ক্ষীণ ক্ষমতা খুব সামান্যই তাতে যোগ কিংবা বিয়োগ করতে পারে। আমরা এখানে কী বলছি তার সামান্যই কিংবা কোনো কিছুই হয়ত পৃথিবী মনে রাখবে না, তবে তারা যা করেছিলেন এই ভূমি কখনোই তা ভুলে যাবে না।

আমরা যারা এখন আছি তাদের, বরং, সেই অসমাপ্ত কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে হবে যেগুলো এখানে যারা লড়াই করেছেন সেসব লোকেরা এমন মহানভাবে অর্পণ করেছেন। আমাদেরকে বরং সামনে থাকা মহান কাজে উৎসর্গ হতে হবে – যেন যে উদ্দেশ্যে তারা তাদের আত্মত্যাগের শেষ বিন্দু পর্যন্ত দিয়েছেন ওই কাজে ওইসব মহিমান্বিত শহিদদের কাছ থেকে আমরা প্রতিনিয়ত উৎসাহ নিই – যেন আমরা দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারি যে, এসব শহিদদের মৃত্যু বৃথা না যায় – যেন এই জাতি সৃষ্টিকর্তার অধীনে নতুন স্বাধীনতা লাভ করে – এবং যেন জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার, পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যায়।’

মাত্র দুই মিনিটে ২৭২ শব্দের এই বিখ্যাত ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের। ১৮৬৩ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রে তখন চলছে তুমুল গৃহযুদ্ধ। ওই বছরের ১-৩ জুলাই তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভানিয়ার গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষ নিহত হয়। তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে যুদ্ধের প্রায় চার মাস পর ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে এক স্মরণসভায় লিংকন এই সংক্ষিপ্ত ও দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ দেন। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ।

এই ভাষণের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হলো মাত্র একটি বাক্যে গণতন্ত্রের নিখুঁত সংজ্ঞা দিয়েছেন লিংকন। তার ভাষ্যমতে, ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার’। তার এই ভাষণ পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঠ্যবইয়ে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

১৮৬৩ সালের ওই দিন প্রচলিত নিয়মে অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত বাগ্মী অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট। তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। পরবর্তী সময়ে লিংকন বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন। ফটোসাংবাদিকরা ঠিকমতো ক্যামেরা সেট করার আগেই দুই মিনিটের মাথায় তিনি বক্তৃতা শেষ করেন।

পরবর্তী সময়ে সেই অনুষ্ঠানের মূল বক্তা অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট দুঃখ করে বলেন, ‘আমি যদি আমার দুই ঘণ্টার বক্তৃতায় লিংকনের দুই মিনিটের বক্তৃতার মূল কথার কাছাকাছি কিছু বলতে পারতাম, তাহলে জীবন ধন্য হতো।’

আব্রাহাম লিংকন ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল ওয়াশিংটনে জন উইকস বোথ নামের এক রাজনৈতিক কর্মীর গুলিতে নিহত হন। তবে এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দুই মিনিটের সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণের জন্য।



মন্তব্য চালু নেই