যেদিন প্রাণের নবী পৃথিবীতে এলেন

মহানবী (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তাই তাঁর জন্মও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে।

তাঁর জন্মকে কেন্দ্র করে অনেক আশ্চর্যজনক কাজের জন্ম হয়েছে, যা সব জাতিকে বিমোহিত করেছে। সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি তিনি, যাঁর স্মরণ সব জাতি সব যুগে করেছে। তিনি সেই মহামানব, যাঁর নাম ইঞ্জিল ও তাওরাতে আছে। সেখানে তাঁর নাম হলো আহমদ। তাঁর প্রশংসা করবে আসমান ও জমিনবাসী। আর তাঁর নাম কোরআনে মুহাম্মদ। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩২৪)

মহানবী (সা.)-এর জন্মের মাস কারো কারো মতে রমজান, কারো মতে রজব। তবে রবিউল আউয়ালই প্রসিদ্ধ মত। জন্মতারিখ নিয়েও আছে মত-দ্বিমত। নিম্নে তারিখ নিয়ে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরা হলো—

এক. কেউ বলেন, রবিউল আউয়ালের দুই তারিখ।

দুই. কেউ বলেন, রবিউল আউয়ালের আট তারিখ। বেশির ভাগ মুহাদ্দিসিন একে বিশুদ্ধ বলেছেন।

তিন. কেউ কেউ ৯ রবিউল আউয়াল বলেছেন।

চার. ইবনে ইসহাক বলেন, মহানবী (সা.) হাতির ঘটনার বছর ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেছেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৫৮)

বেশির ভাগ সিরাতপ্রণেতার কাছে এটাই প্রাধান্য মত।

আর রহিকুল মাকতুম গ্রন্থে এসেছে : সায়্যিদুল মুরসালিন মক্কায় বনি হাশিমের ঘাঁটিতে সোমবার সকালে ৯ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন, যে বছর হাতির ঘটনা হলো। আর আনু শিরোয়ানের ক্ষমতা দখলের ৪০ বছর হলো, তা ২২ এপ্রিল ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক হয় (আর রাহিকুল মাকতুম, খণ্ড-১, পৃ. ৪৫)

জন্মের অলৌকিকতা

হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহর আমার প্রতি সম্মান হলো, আমি খতনাবিশিষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছি। যাতে আমার লজ্জাস্থান কেউ যেন না দেখে। (মুজামে আওসাত, হাদিস : ৬১৪৮)

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত : এক ইহুদি মক্কায় ব্যবসা করত। যে রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, সে রাতে সে কুরাইশের এক মজলিশে বলে, ‘হে কুরাইশদল! তোমাদের মধ্যে কি আজ রাতে কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে?’ তারা বলল, আল্লাহর কসম, আমরা জানি না। সে বলল—‘আল্লাহু আকবার, তোমরা না জানলে কোনো সমস্যা নেই; তবে তোমরা দেখো ও স্মরণ রাখো,

আমি যা বলছি। আজ রাতে এই শেষ উম্মতের নবী জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে একটি নিদর্শন থাকবে, সেখানে কিছু চুলের গুচ্ছ রয়েছে, তা দেখতে ঘোড়ার কাঁধের চুলের মতো, তিনি দুই রাত দুধ পান করবেন না। তার কারণ, এক জিন তার আঙুল তাঁর মুখে প্রবেশ করিয়েছে, তাই তিনি দুধ পান করবেন না। ’

তখন তারা তার মজলিস সমাপ্ত করল, আর তার কথা শ্রবণ করে আশ্চর্য বোধ করল। তারা যখন বাড়ি ফিরল, প্রত্যেকে নিজের পরিবারকে সংবাদ দিল। তারা বলল, আজকে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের এক সন্তান জন্মগ্রহণ করল। তারা তাঁর নাম মুহাম্মদ রাখল। কুরাইশ দল আবার একত্রিত হলো। তারা বলল, তোমরা কি ইহুদির কথা শ্রবণ করেছ, আর তোমরা কি জানো অমুখ বাচ্চার জন্মের কথা। তখন তারা ইহুদির কাছে গেল। আর তাকে তাঁর জন্মের সংবাদ দিল। তখন সে বলল, তোমরা আমাকে নিয়ে তাঁর কাছে যাও, তখন তারা তাকে আমিনার সেখানে প্রবেশ করাল, আর সে বলল, আপনার ছেলেকে আমাদের সামনে বের করুন, তখন তিনি বের করলেন, আর সে তাঁর পিঠ দেখল। তখন সেই নিদর্শন দেখতে পেল, সঙ্গে সঙ্গে ইহুদি বেহুঁশ হলো। তারা বলল, তুমি ধ্বংস হও! তখন সে বলল, আল্লাহর কসম! নবুয়ত বনি ইসরাইল থেকে চলে গেল; তাই তোমরা—হে কুরাইশ দল! শান্তি পেলে। আর আল্লাহর কসম! সে তোমাদের ওপর আক্রমণ করবে, তাঁর সংবাদ পূর্ব থেকে পশ্চিমে পৌঁছে যাবে। (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৪১৭৭)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একসময় শয়তান আসমানে যেতে পারত। গিয়ে ফেরেশতাদের গায়েবি সংবাদ শ্রবণ করত। তা তাদের গণকদের কাছে দিত। যখন ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করলেন, তখন তাদের তিন আসমান থেকে বিরত রাখা হলো। আর যখন মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করলেন, তখন তাদের সব আসমান থেকে বিরত রাখা হলো। তাই তাদের কেউ যখন কিছু শ্রবণ করার জন্য যেত, তখন তাদের আগুনের স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করা হতো। (তাফসিরে কবির, খণ্ড ১৯, পৃষ্ঠা ১৩০)

হজরত ওসমান ইবনে আবিল আস বলেন, ‘আমাকে আমার মা বলেছেন, তিনি আমিনা বিনতে ওয়াহাবের জন্মের সময় ছিলেন। তিনি বলেন, তখন সব বস্তুকে নূর মনে হলো, আর আমি তারকারাজি দেখেছি, তারা অবনমিত হলো। মনে হয় আমার কোলে পড়বে। (দালাইলুন নবুয়্যাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১১১)

যে রাতে মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, সে রাতে কিসরার রাজপ্রাসাদে কম্পন ধরে। আর সেখান থেকে ১৪টি গম্ভুজ ভেঙে পড়ল। তা দ্বারা তাদের ১৪ জন ক্ষমতাবান হওয়া বোঝানো হলো। তাদের ১০ জন চার বছরে ক্ষমতায় এলো। আর বাকিরা ওসমান (রা.) শহীদ হওয়া পর্যন্ত ছিল। আর পারস্যের আগুন নিভে গেল, যা হাজার বছর ধরে নেভেনি। আর সাওয়ার ছোট নদীর পানি শুকিয়ে গেল (বায়হাকি, দালাইলুন নবুয়্যাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১২৬)

আবু রবি ইবনে সালিম বলেন, বাকি ইবনে মাখলাদ তাঁর তাফসিরে লেখেন, নিশ্চয়ই ইবলিশ চারবার বড় আওয়াজে চিৎকার করেছে। একবার যখন তাকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। আরেকবার যখন তাকে দুনিয়ায় নামানো হয়েছে। আরেকবার যখন মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন। আরেকবার যখন সুরা ফাতিহা অবতীর্ণ করেছেন। (উইনুল আছার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৪)

কাজি আয়াজ বলেন, আবদুর রহমান ইবনে আওফের মাতা শিফা থেকে বর্ণিত। তিনি তাঁর ধাত্রী ছিলেন, আর তিনি বললেন, যখন তিনি তার হাতে এলেন আর চিৎকার করলেন—তখন এক ঘোষককে বলতে শুনেছেন : আল্লাহ তোমাকে রহম করুন। আর তার থেকে একটি নূর বের হলো, যা দ্বারা রোমের প্রাসাদ দেখা গেল। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩২৪)

মহানবী (সা.)-এর জন্মের দিনে করণীয়

প্রতি সোমবার রোজা রাখা মহানবী (সা.)-এর জন্মের কারণে মুস্তাহাব।

হজরত আবু কাতাদাহ আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.)-কে একদিন রোজা ও একদিন ইফতার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তিনি বলেন, তা আমার ভাই দাউদের রোজা। তাঁকে সোমবার রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তখন তিনি বললেন, সেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি ও সেদিন আমি নবুয়ত পেয়েছি বা আমার ওপর ওহি অবতীর্ণ হলো। তারপর তিনি বললেন, প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা ও এক রমজান থেকে অপর রমজান পুরো জীবন রোজা রাখার সমান। আর তার থেকে আরাফার রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তখন তিনি বলেন, তাতে এক বছর আগের পাপ ও এক বছর পরের পাপ ক্ষমা হয়ে যাবে। তাঁর কাছে আশুরার রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তিনি বলেন, তা আগের এক বছরের পাপ মুছে দেয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)
লেখক : লেকচারার, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।-কালের কন্ঠ



মন্তব্য চালু নেই