ক্লিন ক্যাম্পাসে আপাতত সেফ ছাত্রলীগ
কিছুদিন আগেও থামানো যাচ্ছিল না বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। দেশের ইতিহাসে অংশীদারত্বের সাক্ষী আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই ছাত্রসংগঠনটি মূলত আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জড়িয়ে পড়েছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষসহ নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায়। তাদের নেতিবাচক ভূমিকায় বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি সরকারও। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরাও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ত্যক্তবিরক্ত।
ছাত্রলীগের এমন ভূমিকার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ১ ডিসেম্বর থেকে ‘ক্লিন ক্যাম্পাস সেফ ক্যাম্পাস’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এই কর্মসূচি শুরুর পর চার দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আর কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনায় জড়ায়নি ছাত্রলীগ।
লক্ষ করা গেছে, সারা দেশে ছাত্রলীগের ‘ক্লিন ক্যাম্পাস সেফ ক্যাম্পাস’ কর্মসূচি সফল করতে আওয়ামী লীগের নেতারাও উপস্থিত থাকছেন। এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে তারা ইতিবাচক কাজের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগকে পুরোনো ইতিহাস-ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিচ্ছেন। কারো সমালোচনার দিকে না তাকিয়ে ভালো কাজ করে যাওয়ার উৎসাহ জোগাচ্ছেন।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এমনকি বর্তমান সরকারের মেয়াদে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চার শতাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়। যার বেশির ভাগই ঘটেছে নিজেদের মধ্যে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক জায়গায় এ সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রলীগের এমন সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অচল হয়ে পড়ে।
এসব ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রাক্তন এক সভাপতি বলেন, দেশের বিভিন্ন ইউনিটে ছাত্রলীগের এসব সমস্যার কারণ শুধু ছাত্রলীগ নয়। এসব ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংসদ বা মন্ত্রীদেরও দায় আছে। এরা অনেকে রাজনীতির মাঠে ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময় এদের ক্রীড়নক হয়ে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যেই জড়িয়ে পড়ে এসব ঘটনায়।
এর আগে ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠন করার পরপরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। সে সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে না আসায় ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’র পদ ছেড়ে দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। গত ১৭ জানুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের ৪০ নেতা-কর্মী আহত হন। গত ১৫ জানুয়ারি বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (মুসলিম) ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর আগে ১২ জানুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ফের হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তার আগে গত ১৯ নভেম্বর শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
এ ছাড়া তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ৬ জানুয়ারি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হক ও দেবাশীষ দাশের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, ‘ছাত্রলীগ হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তৈরির সংগঠন। এ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও উদ্যোগে শামিল করাতে হবে। ছাত্রলীগের মধ্যে ইতিবাচকতাই বেশি। সুযোগসন্ধানীরা এর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। সঠিক নির্দেশনা পেলে গৌরবময় এ সংগঠনটি আবারও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গঠনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে অগ্রণী সৈনিকের ভূমিকা পালন করতে পারবে।’
প্রসঙ্গত, গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের `ক্লিন ক্যাম্পাস অ্যান্ড সেফ ক্যাম্পাস` কর্মসূচি উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন,‘প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে ছাত্রলীগ সাত দিনব্যাপী `ক্লিন ক্যাম্পাস অ্যান্ড সেফ ক্যাম্পাস` কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তার আগে গত ১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ছাত্রলীগকে এই কর্মসূচি পালন করার পরামর্শ দেন। `আমাদের শিক্ষাঙ্গন আমরাই পরিচ্ছন্ন রাখব` এমন প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ছাত্রলীগ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন সপ্তাহব্যাপী এই পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করছে।
গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ও প্রাক্তন ছাত্রলীগ সভাপতি ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি ছাত্রলীগের উদ্দেশে বলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা যেভাবে ক্যাম্পাসের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করছে একইভাবে ছাত্ররাজনীতিকেও আবর্জনামুক্ত করে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। গুটিকয়েক নেতা-কর্মীর জন্য গোটা ছাত্রলীগ বদনামের ভাগীদার হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোনালি অর্জন বৃথা যেতে পারে না। তাই ক্যাম্পাসকে আবর্জনামুক্ত করলেই হবে না, পুরো ছাত্ররাজনীতিকে আবর্জনা মুক্ত করতে হবে।
বুধবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এই কর্মসূচি উদ্বোধনকালে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ছাত্রলীগের উদ্দেশে বলেন, মিডিয়া সব সময় ছাত্রলীগ নিয়ে নেগেটিভ খবর প্রচার করে। কিন্তু ভালো কাজের খবর প্রচার করে না। ছাত্রলীগের ভেতরে কিছু অনুপ্রবেশকারী রয়েছে, যারা খারাপ কাজ করে । আর মিডিয়া সেটাই ফলাও করে প্রচার করে।’
সাত দিনব্যাপী এই কর্মসূচি ঘোষণা করার পর এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগের মধ্যে তেমন কোনো বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, ‘ছাত্রলীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও আন্দোলন-ইতিহাস’র অংশীদার। ছাত্রলীগ দেশের সব অর্জনে সব সময় ছিল, থাকবে। ছাত্রসংগঠনের মধ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। এটাকে অনেকে রং মাখিয়ে বিভিন্ন রকম সংবাদ পরিবেশন করে, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতকে শক্তিশালী করে।’
‘ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের সাথি ছিল, শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নেও পাশে আছে, আগামী দিনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সকল পরামর্শের অপেক্ষায়ও থাকবে’ বলেও জানান তিনি।
মন্তব্য চালু নেই