আবাহনী-মোহামেডানের ‘সন্ধি’ হয়েছিল যেদিন

আবাহনী-মোহামেডান নাম নিতেই একটা যুদ্ধংদেহী দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখন হয়তো এই লড়াই রং হারিয়েছে, কিন্তু ৩০ বছর আগে ব্যাপারটা তো ছিল এমনই। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে গ্যালারিতে বিভক্ত হয়ে থাকা দুই দলের সমর্থককুলেও তো সে সময় যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা দেখা যেত। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়েই দুই দলের সৈনিকদের ‘সন্ধি’—ব্যাপারটা একটু কেমন শোনায় না! আজ থেকে ২৯ বছর আগে আবাহনী-মোহামেডান লড়াইয়ে এমনই এক ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। ৯০ মিনিটের প্রবল লড়াই শেষে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের খেলোয়াড়েরা মাঠে দাঁড়িয়ে ‘সন্ধি’ করেছিলেন। নিজেরাই নিজেদের ঘোষণা করেছিলেন ‘যুগ্ম বিজয়ী’ হিসেবে। এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো অজানা। কিন্তু ১৯৮৭ সালের এই ঘটনা আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথের ইতিহাসে থেকে গেছে এক নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবেই।

১৯৮৭ সালে লিগের শেষ ম্যাচ ছিল ওটা। তারিখটা ৯ সেপ্টেম্বর। শেষ ম্যাচ না বলে বলা উচিত প্লে–অফ ম্যাচ। শেষ ম্যাচটি হতে পারত ওই লড়াইয়ের ৩ দিন আগেই, ওটাও ছিল আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যে।

কাগজে-কলমে ওটাই ছিল ওই মৌসুমের শেষ ম্যাচ। সে সময় লিগে জয়ের জন্য ২ পয়েন্ট আর ড্রয়ে দেওয়া হতো ১ পয়েন্ট করে, পরে আন্তর্জাতিক নিয়মের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা লিগেও জয়ে ৩ পয়েন্ট দেওয়া শুরু হয়। তো ৬ সেপ্টেম্বরের ম্যাচের আগে আবাহনী মোহামেডানের চেয়ে ২ পয়েন্ট এগিয়ে ছিল। সমীকরণটা ছিল, ওই ম্যাচে আবাহনী ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন। মোহামেডান জিতলে দুই দলের পয়েন্ট সমান হয়ে যাবে।

৬ সেপ্টেম্বর ৩-২ গোলের স্মরণীয় জয় পেয়েছিল মোহামেডান। সেটাও এক দুর্দান্ত লড়াই। প্রথমে মোর্তজার গোলে এগিয়ে যাওয়া মোহামেডানকে খেলা থেকে প্রায় ছিটকে দিয়েছিলেন আবাহনীর সে সময়কার অধিনায়ক শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও শ্রীলঙ্কান ফুটবলার প্রেমলাল। ২-১ গোলে এগিয়ে গিয়ে আবাহনী যখন লিগ শিরোপা জয়ের উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই পেনাল্টি থেকে গোলে এমেকা ২-২ করেন। তাতেও ভড়কে যায়নি আবাহনী, ড্র হলেও তো তারাই চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু খুরশিদ আলম বাবুল দারুণ এক গোল করে আবাহনীর কপাল পোড়ান। মোহামেডানের জয় ৮৭–র লিগকে টেনে নিয়ে যায় রোমাঞ্চকর এক শেষের দিকে। দরকার হয়ে পড়ে একটা প্লে-অফ ম্যাচের।

৯ সেপ্টেম্বর। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সারা দেশ উৎকণ্ঠায়। কে জিততে যাচ্ছে লিগ শিরোপা। প্রতিটি ঘর বিভক্ত আবাহনী-মোহামেডানে। বিকেলে ম্যাচ। সকাল থেকেই জনস্রোত ঢাকা স্টেডিয়ামের (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) দিকে।

কানায় কানায় দর্শকে পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে শুরু হলো ম্যাচ। তিন দিন আগের ম্যাচে শক্তি খুইয়েছে দুই দলই। দুই হলুদ কার্ডে এই ম্যাচে খেলার অধিকার হারিয়েছেন দুই দলের দুই সেরা বিদেশি। মোহামেডানের নাইজেরিয়ান এমেকা ও আবাহনীর ইরাকি ডিফেন্ডার সামির শাকির। সামির শাকির আগের বছরই (১৯৮৬) ইরাকের হয়ে খেলেছেন মেক্সিকো বিশ্বকাপ।

আবাহনীতে সেবার সামির শাকিরের সঙ্গে খেলেছিলেন আরেক ইরাকি বিশ্বকাপ তারকা করিম মোহাম্মদ আলভীও। মোহামেডানে ছিলেন ইরানি ফুটবলার মোর্তজা, নালজেগার ও বোরহানজাদেহ। আবাহনীতে আরও দুই শ্রীলঙ্কান প্রেমলাল ও পাকির আলী।

দারুণ রোমাঞ্চকর ম্যাচ ছিল সেটা। তবে বড় ম্যাচের চাপেই কি না, ছোটখাটো ব্যাপারে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন খেলোয়াড়েরা। রেফারি আনসারুল ইসলাম মিন্টুকে বেশ কয়েকবার খেলা বন্ধ করতে হলো। মাঠে খেলোয়াড়দের হাতাহাতি ঠেকাতে মাঠে ঢুকতে হয় পুলিশকেও। আবাহনীর গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন চড়াও হলেন মোহামেডানের ইরানি ফুটবলার নালজেগারের ওপর। এ নিয়ে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে হাতাহাতির পর রেফারি লাল কার্ড দেখান মোহামেডানের ডিফেন্ডার আবুল হোসেন আর আবাহনীর মিডফিল্ডার মোস্তফা কামালকে (বড় কামাল)। মহসিনকে অবশ্য হলুদ কার্ডের বেশি কিছু দেখাননি রেফারি মিন্টু। হলুদ কার্ড দেখলেন মোহামেডানের ইলিয়াস হোসেনও।

সেবার লিগ কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—যেহেতু শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ, তাই নির্ধারিত ৯০ মিনিট অমীমাংসিত থাকলে অতিরিক্ত সময় ও টাইব্রেকারে যাবে প্লে-অফ ম্যাচটা। ৯০ মিনিট শেষ হয়েছিল গোলশূন্য সমতায়।

ঠিক ওই সময়ই ঘটল সেই ‘সন্ধি’র ঘটনাটি। সে ম্যাচে আবাহনীর অধিনায়ক শেখ মোহাম্মদ আসলাম আর মোহামেডানের অধিনায়ক রনজিত সাহা ৩০ বছর পরেও মনে করতে পারেন সেই স্মরণীয় সন্ধ্যার প্রতিটি মুহূর্ত। সে ম্যাচের মতো উত্তেজনা আর গ্যালারিতে উপচে পড়া দর্শক আজও নাড়া দেয় আসলামকে, ‘কী বলব, জীবনে অনেক আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলেছি। কিন্তু সেদিনকার মতো উত্তেজনা কখনোই দেখিনি। গ্যালারি কানায় কানায় ভরা। খেলার আগে মাঠে ঢোকার সময় বাইরেও হাজার হাজার দর্শক দেখেছি।’

রনজিতের মতে, ম্যাচটা যে দলই হারত, সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতো ভয়াবহভাবেই, ‘আমরা বাজে কিছুর আশঙ্কা করছিলাম। এমনিতে মাঠে আমরা খুব ভালো আচরণ করিনি সেদিন। দর্শকেরাও উত্তেজিত ছিল। ওই ম্যাচে যে দলই হারত, মাঠে গন্ডগোল হতো।’

দর্শক হাঙ্গামার কথা চিন্তা করেই সেদিন নিজেদের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করার কথাটা মনে এসেছিল বলে জানালেন আসলাম, ‘এমনিতেই অতিরিক্ত সময় আর টাইব্রেকারের ব্যাপারটি দুদলের কোনো খেলোয়াড়ই পছন্দ করেনি। ওটা ছিল বাড়তি ঝামেলা। আমরা খুবই ক্লান্ত ছিলাম। ৩ দিন আগে বৃষ্টিভেজা মাঠে এত বড় ম্যাচ খেলেছি। ৩ দিন পর ছিল উল্টো আবহাওয়া। প্রচণ্ড গরম। ওই গরমে ৯০ মিনিট শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ের পর আরও ৩০ মিনিট ও টাইব্রেকারে মন সায় দিচ্ছিল না কারোরই। দর্শক হাঙ্গামার ব্যাপারটিও মাথায় ছিল। মনে আছে, মোহামেডানের কায়সার হামিদ প্রথমে আমার কাছে এসে যুগ্ম চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তাব দেয়। কায়সার খুবই দুষ্টু টাইপের ছেলে। আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম, ও মজা করছে। পরে মোহামেডানের আরও অনেকেই এল, রনজিত এসেও একই কথা বলল। আমি তাৎক্ষণিক কিছু বলিনি। ওদের বলি, আমি আবাহনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানাব। রনজিতও বলেন, আসলাম ভাইকে প্রস্তাবটা আমরাই দিয়েছিলাম। আমি দর্শকদের নিয়ে খুব শঙ্কিত ছিলাম। সত্যি বলতে কি নিজেদের নিয়েও শঙ্কা ছিল। সেদিন যে-ই হারত স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়াটা মুশকিল হতো।’

আসলাম প্রস্তাবটা নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করতে যাবেন, এমন সময় ঘটে অভাবনীয় ঘটনা। মোহামেডানের কায়সার হামিদ, আবাহনীর এফ আই কামালসহ বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় কোথা থেকে যেন আবাহনী ও মোহামেডানের বিশাল দুটি পতাকা আনেন। দুটো পতাকা নিয়েই শুরু হলো ল্যাপ অব অনার। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দর্শকেরা। তাঁরা কী করবেন! সংবিৎ ফিরে পেয়ে গ্যালারির ৫০ হাজার দর্শকও শামিল হলো খেলোয়াড়দের সঙ্গে। বিপুল করতালিতে ব্যাপারটিকে স্বাগত জানাল তারাও। আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ গড়ল এক নতুন ইতিহাস।

খেলোয়াড়দের সেই ‘সন্ধি’ মেনে নেয়নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। তীব্র প্রতিক্রিয়াই আসল তাদের কাছ থেকে। খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে উঠল বাইলজ ভঙ্গে অভিযোগ।

সবচেয়ে বড় দায় মেটাতে হলো দুই অধিনায়ককে। আসলাম আর রনজিতকে নিষিদ্ধ করা হলো পরবর্তী এক বছরের জন্য। অন্য খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো।

প্লে-অফের নতুন তারিখ নির্ধারিত হলো ২৬ অক্টোবর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিদ্ধান্ত হলো খেলাটা হবে আর্মি স্টেডিয়ামে, দর্শকবিহীনভাবে। টেলিভিশনে খেলা সরাসরি সম্প্রচারিত হবে, কিন্তু দর্শকেরা মাঠে ঢুকতে পারবেন না।

আবাহনীর তীব্র আপত্তি ছিল নতুন প্লে-অফের তারিখ নিয়ে। কিন্তু নানা চাপে তাদের খেলতে হয় ম্যাচটা। মোহামেডান ২-০ গোলে আবাহনীকে হারিয়ে জিতে নেয় ১৯৮৭ সালের লিগ শিরোপা।

২৯ বছর পর আজ আরও একটি আবাহনী-মোহামেডান লড়াই। সেই একই মাঠে। কিন্তু ২৯ বছর আগের পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে আজকের কত পার্থক্য। আবাহনী-মোহামেডান আছে, কিন্তু সেই আনন্দ আর সর্বজনীন উত্তেজনা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।-প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই