খালেদাকে জাফরুল্লাহর খোলা চিঠি

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে খোলা চিঠি লিখেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। চিঠিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সমালোচনা করে দলের গঠনতন্ত্র সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

খালেদার কাছে লেখা খোলা চিঠিতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উল্লেখ করেন, দলে গণতন্ত্র নেই। থাকলে কমিটি নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হতো না। পরিবারতন্ত্র এত পাখা বিস্তার করতো না। ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্বার্থে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত বাড়িতে বসেই তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন।

চিঠির শুরুতেই ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করায় খালেদার প্রশংসা করে জাফরুল্লাহ বলেন, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী মন্তব্য করেছেন তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি জিতেছেন। সবার সঙ্গে আলাপ করে জামায়াত সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বিকল্পধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, জাসদ (রব) প্রভৃতিকে নিয়ে এক মাসের মধ্যে জনসভা করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

দীর্ঘ খোলা চিঠিতে জাফরুল্লাহ দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, আজ আপনি জিয়াউর রহমানের সুন্দরী বালিকা বধূ নন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আপনি পরিশ্রম ও ধীশক্তির বলে দু’দফায় নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশের ৪-৬ কোটি মানুষ আপনার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তাদের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনুন। সে দেশে এসে আপনার মতো গুণ, সততা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। দুর্নীতি ও গুন্ডামির মাধ্যমে নয়, জিয়াউর রহমানের মতো সততার ভিত্তিতে, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনীতিতে আপনার স্থানটা নেয়ার চেষ্টা করুক।

খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে মাওলানা ভাসানী যে ঐতিহাসিক দায়িত্বভার নিয়েছিলেন আপনাকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। ইসলামাবাদের জিঞ্জির ছিঁড়েছি, দিল্লির অনুগত হওয়ার জন্য নয়, ভাসানীর মতো এ ধরনের বক্তব্য দিতে হবে। ভারতের অনৈতিক কার্যকলাপের কথা বেশি বেশি বলার পরামর্শ দেন তিনি।

ঘোষিত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করে জাফরুল্লাহ বলেন, সব মনোনয়ন দানের জন্য গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তবে পরিষ্কারভাবে লিখিত আছে যে, ‘দলের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে চেয়ারম্যান দলের সর্বময় কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ, তদারক ও সমন্বয় সাধন করবেন।’

জাতীয় কমিটিতে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী আবদুল আলীম ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্থান অযৌক্তিক ও ভুল সিদ্ধান্ত। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে তো কোনো দলীয় রাজনীতিতে নেই বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, আপনার সিনিয়র নেতারা বিশেষ করে এম আদ্যাক্ষরের নেতারা আপনাকে দিয়ে গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করিয়েছেন। যে ক্ষমতা আপনাকে দেয়া হয়নি সে ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মীদের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছেন। আপনাকে পক্ষান্তরে একরোখা একনায়করূপে চিত্রিত করেছেন।

খোলা চিঠিতে জাফরুল্লাহ আরো উল্লেখ করেন, গঠনতন্ত্র সংশোধন করে প্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ২৫ জন করলে আপত্তি কোথায়? সদস্যরা পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ২-৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন।

চিঠির শুরুতে জাফরুল্লাহ ১৫ আগস্ট জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান বাতিল করায় প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, একই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু শিশুর জন্ম হবে। কিছু মানুষের মৃত্যু হবে, কতক বিয়ে হবে, তালাক হবে, এমনকি শিশুর আকিকাও হবে। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভিন্ন গুরুত্ব আছে। এদিন দুই কন্যা ছাড়া দেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এটা শোকের দিন। এদিনে জন্ম দিবস পালন না করাটা অবশ্যই ভালো কাজ।

তিনি উল্লেখ করেন, খালেদা জিয়াকে ১৯৭২ সালে আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম যেদিন দেখি তখন তার চেহারায় বুদ্ধির দীপ্তি দেখিনি। কর্নেল জিয়াউর রহমান তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করার জন্য আমাকে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের ৬নং বাংলোতে বৈকালিক চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। ওই বছর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জিয়াকে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্ব দেন। পরে বন্দর ও নৌ-মন্ত্রী জেনারেল এমএজি ওসমানীর পরামর্শে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেন ও ক্যান্টনমেন্টে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে বলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহ ও জিয়াকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে কমান্ডার ইন চিফ ও মেজর জেনারেল জিয়াকে ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ মনোনীত করেন। জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধু যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সে দায়িত্ব নিয়ে সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলে বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনাটি ঘটতো না।

চিঠিতে জাফরুল্লাহ জানান, দেরিতে বড় কমিটি দিয়েও ভুল করেননি। ভুলটা হয়েছে অন্য জায়গায়। আপনার দলের কিছু চাটুকার দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক, সরকারের দমন নীতিতে ভীতসন্ত্রস্ত সিনিয়র নেতা আপনাকে ভুল বুঝিয়েছেন। তারা আপনার ওপর জাতীয় কমিটি মনোনয়নের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আপনাকে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাস ও সম্মান দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দলের প্রতি তাদের আনুগত্যের অভাব ও দায়িত্ব এড়ানোর প্রচেষ্টাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

তিনি আরো উল্লেখ করেন, আমার মনে হয়, দীর্ঘদিন আপনি বিএনপির গঠনতন্ত্র পড়েননি এবং আপনার মনোনীত নির্বাহী কমিটির সদস্যদের অধিকাংশও পড়েননি। কমিটিতে কম সংখ্যক মহিলাদের স্থান দেয়ারও সমালোচনা করেন তিনি। ধর্ম বিষয়ে তিনজনসহ সম্পাদকের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা কাউন্সিলের আকার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন জাফরুল্লাহ। বিএনপির একনিষ্ঠ সুহৃদ অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের নাম উপদেষ্টার তালিকায় নেই। তাকে খালেদা জিয়ার প্রধান উপদেষ্টা করলে বিএনপির লাভ হবে এবং খালেদা জিয়া দেশবাসীর প্রশংসা পাবেন। গুণী শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহী ও সাহসী হতেন গুণীজনের কদর দেখে।

চিঠিতে আরো বলা হয়, দলের (বিএনপি) সদস্য নয় অথচ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও সুদক্ষ ব্যক্তিদের কোঅপ্ট করার বিধান আছে। এই বিধানবলে অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ফেরদৌস আজিম, উপাচার্য পারভীন হাসান, নারী পক্ষের শিরীন হক, অধ্যাপক আইনুন নিশাত, অধ্যাপক (ড.) এম আর খান, বারডেমের ডা. একে আজাদ খান, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, বিআইডিএসের বিনায়ক সেন, সাবেক আমলা আলী ইমাম মজুমদার, সা’দত হোসেন, শওকত আলী, আলী আকবর খানসহ আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কোঅপ্ট করলে কমিটির কাজের গুরুত্ব বাড়বে এবং বিএনপি জ্ঞানসমৃদ্ধ হবে ও ভবিষ্যতে দেশ শাসনে আপনার সুবিধা হবে।

চিঠিতে ভারতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি রামপাল সম্পর্কে মৃদু প্রতিবাদ করেছেন, আপনার দলকে অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেননি। আপনাকে বিব্রত করার জন্য সরকার জামায়াত ইস্যু প্রায়ই তুলে ধরছে। আপনি পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ইস্যু এনে যোগ করাচ্ছে। জনগণ পরিবর্তন চায়, দুর্নীতিমুক্ত সুষ্ঠু গণতন্ত্রের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে।

জরুরি ভিত্তিতে দলের ঘোষণা ও গঠণতন্ত্রের সংশোধন প্রয়োজন বলে তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই নিমিত্তে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন, দিলারা চৌধুরী, আসিফ নজরুল ও মাহবুবুল্লাহ প্রমুখকে দিয়ে কমিটি করে দিন। ১৫ দিন সময় বেঁধে দিন। জাতীয় কাউন্সিল ও স্থায়ী কমিটির জরুরি মিটিংয়ে তাদের সুপারিশসমূহ আলোচনা করুন। পরপরই ইউনিয়ন, উপজেলা ও মহানগর কমিটি গঠন এবং ছাত্রদল, নারী দল ও শ্রমিক দলে নির্বাচন দিন।

চিঠির সবশেষে জাফরুল্লাহ খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, ২০ দলের বাইরের বিরোধীদলগুলোকে একত্রিত করে বাংলাদেশে জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দেলনকে সুসংহত করার জন্য আপনার হাতে সময় আছে বড়জোর নয় মাস। সম্ভবত এই সময়ের মধ্যে আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় রাজনীতির আলোকে বিচারের রায় বেরোবে। এই কয়েক মাস পরিশ্রম করলে জনগণের রায় আপনার পক্ষে আসার সম্ভাবনা সমধিক। ইতোমধ্যে তারেক রহমানের মামলার রায় বেরিয়েছে। অনৈতিক কমিশন নেয়ার মামলায় আদালত তারেক জিয়াকে ৭ বছরের জেল দিয়েছেন। এটা কি সুষ্ঠু বিচারের রায় না রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এর ফয়সালা ছাত্রদলের ২০-৩০ জনের মিছিলে হবে না। এতে কেবল আপনাদের শক্তির অপচয় এবং ভুল কাজ। ফয়সালা হবে মূলত সুষ্ঠু গণতন্ত্রের আন্দোলনে এবং উচ্চ আদালতে।

চিঠিতে তিনি আরো উল্লেখ করেন, প্রতি মাসে আপনাকে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে ন্যূনতম দুটি করে জনসভা করতে হবে। সরকারের নানা অপকর্ম এতে তুলে ধরুন। তার ভাষ্যমতে, আপনার দৃঢ়চেতা পদক্ষেপ আমাদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত নিরাপদ হবে এবং তারেক জিয়ার দেশে ফেরার পথ সুগম হবে। জাতীয় ঐক্যে বন্ধ হবে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ।

জাফরুল্লাহ উল্লেখ করেন, জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। বুঝেসুজে সবার সঙ্গে আলাপ করে জামায়াত সম্পর্কে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিন। দেশবাসীর কাছে তাদের পুনরায় ক্ষমা চাইতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই