পণ্য বাণিজ্যে দেশের সামগ্রিক ঘাটতি কমেছে

একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভর করে পণ্য বাণিজ্যের সক্ষমতা এবং পরিস্থিতির উপর। এই সূচকে গত ‍দুই বছর ধরে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমে এসেছে। এ সময়ে আমদানি ব্যয় বাড়ার তুলনায় রপ্তানি আয় বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ যে বলিষ্ঠ অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বাণিজ্য ঘাটতি কমার বিষয়টি সেটাই ইঙ্গিত করে। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, বৈশ্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ যে খাতগুলোতে শক্তিশালী, সেগুলোতে ভাল করছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্য বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণায় অনেকেই বাংলাদেশের পোশাক খাতের পরিণতি দেখে ফেলেছিলেন। অথচ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় আগের মতোই বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) থেকে দেখা গেছে, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সামগ্রিক আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৭১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। অপর দিকে ইপিবির প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একই সময়ে রপ্তানি আয় ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।

আবার এলসির প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরে এফওবি ভিত্তিক এবং ইপিজেডসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৭১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। আর ইপিবি বলছে, এর বিপরীতে সব ধরনের পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতি ৫৪৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার। যা আগের বছরের তুলনায় ১৪৯ কোটি ১৮ লাখ ডলার বা ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ কম।

এসব পরিসংখ্যান নির্দেশ করে, দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে। কারণ গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বাড়ার তুলনায় রপ্তানি আয় বেড়েছে, যা অর্থনীতির জন্য খুব ইতিবাচক।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে যাচ্ছি। আমাদের উৎপাদনও অনেক ভালো, চালের ভালো মজুদ রয়েছে। তাই খাদ্য আমদানির পরিমাণ কমে গেছে। এটি অবশ্যই অর্থনীতির জন্য ভালো। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানি তেলের দাম কমায় আমদানি খাতে খরচ কমেছে। সে কারণে এবার আমদানি খাতে ব্যয় খুব বেশি বাড়েনি। এতে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে।’

তিনি বলেন, তবে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। দেশে এখন স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। এই অবস্থায় যেমন বিনিয়োগ প্রত্যাশিত, তা হচ্ছে না।

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, যেহেতু এখন পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ক্রমেই কমছে। এর সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়লে, সামষ্টিকভাবে দেশের জাতীয় অর্থনীতি আরো সুষ্ঠু ও উন্নত হতো।

এ জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট এবং নীতি-নির্ধারকদের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি।

জানা গেছে, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি আয় কম হওয়ায় প্রতি বছরই বাংলাদেশে বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। তবে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমান্বয়ে কমেছে। এরপর গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কিছুটা বাড়লেও সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এলসি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছর আমদানি খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৭৬৬ কোটি ৬২ লাখ ডলার। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সামগ্রিক আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৭১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আমদানি ব্যয় ২০৪ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার বেড়েছে। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি।

এ ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের বেশ কিছু খাতে আমদানি ব্যয় কমেছে। এর মধ্যে খাদ্য পণ্য আমদানি খাতের ব্যয় ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং জ্বালানি তেল আমদানি খাতের ব্যয় ৩৫ শতাংশ কমেছে।

ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খাদ্যপণ্য (চাল ও গম) আমদানির জন্য ১০৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। একই সময়ে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য মোট ২১৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন আমদানিকারকরা। এটি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম।

অন্যদিকে ইপিবির তথ্য মতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ৮৯ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের রপ্তানি ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়েছে।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বাড়ার তুলনায় রপ্তানি আয় বেশি বাড়ায় বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমে এসেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬৯৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর পরিবর্তে সদ্য সমাপ্ত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৪৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ১৪৯ কোটি ১৮ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে।



মন্তব্য চালু নেই