এক চেয়ারপারসনের ৭৩ উপদেষ্টা!

দলীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কমিটি করেছে সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি। ৫০২ সদস্যের এই কমিটির মধ্যে শুধুমাত্র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্যই উপদেষ্টা রয়েছেন ৭৩ জন। এই উপদেষ্টা কাউন্সিলে অনেকে নতুন, তবে অনেকেই আছেন যাদের বিরুদ্ধে গত কমিটিতে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ থাকায় নিজের উপদেষ্টা হিসেবে জায়গা দিয়েছেন খালেদা জিয়া।

বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, যারা বিগত দিনে আশান্বিত পারফরম্যান্স করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদেরকেই উপদেষ্টা কাউন্সিলে স্থান দিয়েছেন খালেদা জিয়া। আর বিএনপির নেতাকর্মীদের কেউ কেউ মনে করছেন, বিগত বছরে কমিটি না হওয়ায় নেতাজট তৈরি হওয়ার কারণেই বড় কমিটিসহ বিশাল উপদেষ্টা কাউন্সিল করতে বাধ্য হয়েছেন চেয়ারপারসন।

বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, উপদেষ্টা কাউন্সিল বড় হবে এর ইঙ্গিত গত ১৯ মার্চের কাউন্সিলেই দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ওই কাউন্সিলের গঠনতন্ত্রেই উপদেষ্টাদের জন্য বিষয়ভিত্তিক কমিটি করার বিষয়টি পাস হয়। আর এর মূল কাজ শুরু হবে ভিশন ২০৩০ এর বিস্তারিত কার্যক্রম গোছানোর সময়।

কাউন্সিলের চার মাস ১৬ দিন পর গতকাল শনিবার বিএনপির ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুমোদিত কমিটির নাম ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

গত ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়। তারই প্রেক্ষিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যরা হচ্ছেন সারোয়ারি রহমান, রিয়াজ রহমান, হারুনার রশীদ খান মুন্নু, মুশফিকুর রহমান, অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, ফজলুর রহমান পটল, অ্যাডভোকেট কবির হোসেন, উকিল আবদুস সাত্তার, লুৎফর রহমান খান আজাদ, আখতার হামিদ সিদ্দিকী, সাবিহউদ্দিন আহমেদ, এ কে এম মোশাররফ হোসেন, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, মশিউর রহমান, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, অ্যাডভোকট মাহবুবুর রহমান, ইঞ্জিনিয়র আ ন হ আখতার হোসেইন, অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম, জাফরুল হাসান, জয়নুল আবদিন ফারুক, জয়নাল আবেদীন ভি পি, মনিরুল হক চৌধুরী, মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) কামরুল ইসলাম, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, ফজলুল হক আসপিয়া (সুনামগঞ্জ), নুরুল হুদা (চাঁদপুর), সৈয়দ মেহেদি আহমেদ রুমী, আবদুল হালিম, এম এ কাইয়ুম, শহীদুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম, ইসমাইল জবিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাউদ্দিন আহমেদ, আবদুর রশীদ, ব্যারিস্টার হায়দার আলী, ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান, অধ্যাপিকা তাজমেরী ইসলাম, অধ্যাপিকা ডা. শাহিদা রফিক, অ্যাডভোকেট আব্দুর রেজ্জাক খান, রোজী কবির, গোলাম আকবর খন্দকার, কাজী আসাদ, কবির মুরাদ, অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, একরামুজ্জামান, ফজলুর রহমান (কিশোরগঞ্জ), হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, নাজমুল হক নান্নু, তাহমিনা রুশদি লুনা, ড. ইনামুল হক চৌধুরী, ডা.সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, বিজন কান্তি সরকার, সঞ্জীব চৌধুরী, আবদুল হক (সিলেট), অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, অ্যাডভোকেট আফজাল এইচ খান, অ্যাডভোকেট কামরুল মুনির, অ্যাডভোকেট বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক আবদুল বায়েছ ভুঁইয়া, আফরোজা খান রীতা, আবদুস সালাম (ঢাকা মহানগর), ময়নুল ইসলাম শান্ত, মো. শাহজাদা মিয়া, এসএস ফজলুল হক, কর্নেল (অব.) এম এ লতিফ, ডা. মো. আবদুল কুদ্দুস, সৈয়দ আলমগীর হোসেন এমবিএ ও আমিনুল হক এফসিএ।

তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, উপদেষ্টা কাউন্সিলের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী তিনজন অধ্যাপক স্থান পেয়েছেন। বিগত কমিটিতে ছিলেন এমন অনেকেও এই কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। পেশাজীবীদের মধ্যে আইনজীবী, অধ্যাপক, সাংস্কৃতিক কর্মীরাও খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন। উপদেষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিকও।

নেতাকর্মীদের অনেকের ধারণা, উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশ সদস্যই বিগত দিনে কাজ দেখাতে পারেননি। বিশেষ করে খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে পথ দেখানোর কাজটিতে তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৪ সালের পর থেকে খালেদা জিয়ার সর্বসাকূল্যে ১৫-১৬ জন উপদেষ্টা সক্রিয় ছিলেন, বাকিরা ছিলেন লাপাত্তা। এক্ষেত্রে চলতি কমিটিতে ৭৩ জন নিয়োগ পেলেও তাদের কার্যক্রমের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান নেতাকর্মীরা।

তবে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, বিএনপির দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এক্ষেত্রে কমিটি বড় হবে, এটা খুব স্বাভাবিক। আর উপদেষ্টা কমিটি বড় হওয়ার কারণে হচ্ছে, উপদেষ্টাদের কাজ এবার সুনির্দিষ্ট হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক হচ্ছে। প্রত্যেকের কাজই এখন আলাদা হবে এবং ভিন্ন ভিন্ন টিমে কাজ করবেন।

স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, চলতি কমিটিতে বিষয়ভিত্তিক পদ বাড়ানো হয়েছে। এটা সমন্বয় করা হবে উপদেষ্টাদের মাধ্যমে। খালেদা জিয়ার বক্তব্য, বিএনপির রাজনৈতিক বক্তব্য, পোস্টার, ব্যানারের ভাষা প্রণয়নে কাজ করবেন উপদেষ্টারা।

সাবেক উপদেষ্টা ও নতুন কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ম্যাডাম সুচিন্তিত ভাবেই উপদেষ্টা কাউন্সিল বড় করেছেন। অনেক যোগ্য মানুষরা আগে কাজ করতে পিছপা হতেন। এখন থেকে তারাও সক্রিয় হবেন।

নব নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী অবশ্যই বড় উপদেষ্টা কমিটিতে সমস্যার কিছু দেখছেন না, তার ভাষ্য, ক্ষতি কী! কমিটি বড় হলে কাজ হবে না, বা বড় হলে সমস্যা, এমন একাডেমিক সমস্যা তো দেখছি না। সারা বিশ্বেই এখন বড় কমিটি হয়, বড় মন্ত্রিসভা হয়। তো, এতে খারাপ কী আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কাজের পরিধি বাড়লে তো লোকের সংখ্যা বাড়বেই।

নতুন এক যুগ্ম মহাসচিব নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, বসার তো জায়গা নেই, তাহলে বড় কমিটি করে কী হবে। নির্বাহী কমিটির বৈঠক তো খালেদা জিয়া করতে সক্ষম হবেন না। এখন উপদেষ্টাও বাড়ল। তাহলে বৈঠক হবে কই বলে প্রশ্ন রাখেন পেশাজীবী এই যুগ্ম মহাসচিব।

তিনি বলেন, বিষয়ভিত্তিকের যুক্তি দেখিয়ে এত বড় কমিটি প্রয়োজন হয়। কিন্তু, কাজের লোক সব সময় সংখ্যায় কম। এবারও দেখবেন, কমই থাকবে।



মন্তব্য চালু নেই