জেনে নিন, সৌদি খেজুরের চাষ পদ্ধতি
সারা বিশ্বে জলবায়ুর কুফল নিয়ে আলোচনার ঝড় চলছে। দিন দিন বৈরি জলবায়ু আমাদের নানাবিধ সমস্যার সন্মুখিন করে তুলছে। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেমন বাড়িয়ে তুলছে তেমনি বাড়িয়ে তুলছে তাপমাত্রা। ফলে বন্যা, ঝড়, খরার মতো নানা দুর্যোগ আমাদের চিরচেনা পৃথিবীকে করে তুলছে অচেনা।
পৃথিবীর এই পরিবর্তনের পেছনে শিল্পন্নোত দেশগুলোর রয়েছে মুখ্য ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে যেমন শিল্পকারখানার নির্গত ধোঁয়া, বর্জ্য শোধন করতে হবে। পাশাপাশি বেশি করে গাছ লাগিয়ে পৃথিবীকে করে তুলতে হবে সবুজ। এ ক্ষেত্রে আমরা অন্যান্য গাছের পাশাপাশি সৌদির খেজুর গাছ লাগাতে পারি। আমাদের দেশে খেজুরের চাহিদা রয়েছে ৩০ হাজার টন। বিশাল এই চাহিদাকে অনেকাংশই পূরণ করতে পারি দেশে খেজুর গাছের চাষ করে। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ পাকিস্থন খেজুরের চাষ করে বছরে প্রায় ৯০ হাজার টন রফতানি করে থাকে। তাদের দেশের মাটি আমাদের দেশের মাটির তেমন একটা তফাৎ নেই। তারা যদি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করতে পারে তাহলে আমরা রফতানি করতে না পারলেও দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারব বলে আমি আশাবাদী। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মো. মোতালেব হোসেন ভালুকাতে গত নয় বছর ধরে সৌদি খেজুরের চাষ করে আসছেন। বর্তমানে তার বাগানে রয়েছে ২০টির মত খেজুর গাছ। তিনি এক একটা গাছ থেকে বছরে ৪৫ কেজি করে খেজুর পাচ্ছেন। মো. মোতালেব হোসেনের মত আমরা খেজুর গাছের বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে অবশ্যই আশাতীত ফল পাব। আমি ২০০৬ সাল থেকে খেজুরের চারা উৎপাদন শুরু করি। এ পর্যš- কয়েক’শ চারা ক্রেতার কাছে বিক্রি করেছি। আমার এ চারাগুলোতে গত বছর ফুল আসলেও আগামী বছর ফল পাব বলে আশাবাদী।
চাষের নিয়ম কানুন : খেজুর গাছ সাধারণত সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। তারপরও বেলে ও বেলে-দো-আঁশ মাটিতে ভাল জন্মে। তবে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
বীজ থেকে চারা উৎপাদন : বীজ থেকে চারা উৎপাদনের জন্য মাটির তিন ভাগের একভাগ বালি, ছাই, গোবর ও কম্পোস্ট সার এক সাথে মিশাতে হবে। ১০০ কেজি মাটির জন্য ৫০০ গ্রাম রুটোন সার মিলিয়ে তৈরি করতে হবে। বীজ ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর মাটির আধা ইঞ্চি গর্তে বপন করতে হবে। তারপর অল্প পানি দিতে হবে যাতে কাদা না হয়। ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পানি দেবার পর ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর চারা গজাবে। এরপর ৩ মাস পর পর ১ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া গুলিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রোপণ পদ্ধতি : একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের দূরত্ব হবে ১৫ থেকে ২০ ফুট। দিনে কমপক্ষে ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা যাতে রোদ থাকে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। তাতে গাছের বৃদ্ধি ও রোগ-বালাই কম হবে। একর প্রতি ১০০ থেকে ১২১টির বেশি গাছ রোপণ করা যাবে না।
গর্ত তৈরি : খেজুরের চারা রোপণ করতে হলে ৩ ফুট গভীর ও ৩ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট আড়াআড়ি গর্ত করে মাদা বানাতে হবে। উপরের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি উপরে দিতে হবে। সম্ভব হলে গর্তের মাটিতে ১/২ দিন রোদ লাগিয়ে নিলে ভাল হবে। পোকা-মাকড়ের আক্রমণ যাতে না হয় তার জন্য মাটির সাথে গুঁড়ো বিষ মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে।
সার ব্যবস্থাপনা : প্রতিটি গাছের গোড়ায় সামান্য পরিমাণে হাড়ের গুঁড়ো, প্রতি গর্তে ৮ থেকে ১০ কেজি গোবর সার মেশাতে হবে। চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন পরে মিশ্র সার গাছের কমপক্ষে ২ থেকে ৩ ফুট দূরে মাটিতে প্রয়োগ করে পানি স্প্রে করতে হবে। চারা রোপণের পর চারার গোড়া যেন শুকিয়ে না যায় আবার অতিরিক্ত পানিতে যেন কাদা না জমে যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পরাগায়ণ : খেজুর গাছের পরাগায়ণ পোকা-মাকড়, মৌমাছি কিংবা বাতাসের মাধ্যমে খুব কমই হয়ে থাকে। হাত দিয়ে অথবা মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে পরাগায়ণ করতে হবে। বাগানে ১০০টি স্ত্রী গাছের সাথে মাত্র ১টি পুরুষ গাছ থাকলেই পরাগায়ণের জন্য যথেষ্ট। পরাগায়ণ করতে হলে স্ত্রী গাছের ফুল চুরমি ফেটে বাইরে আসার পর পুরুষ গাছের পরাগরেণু পাউডার নিয়ে স্ত্রী গাছের পুষ্পমঞ্জুরিতে লাগিয়ে দিয়ে চুরমির অগ্রভাগ রশি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। ২/৩ দিন পর পর পুনরায় ২/৩ বার পরাগায়ণ করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে পুরুষ গাছের পাউডার সৌদি থেকে আমদানি করে ফ্রিজে -৪ থেকে -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ থেকে ৩ বছর সংরক্ষণ করা যায়।
খেজুর গাছ অনুর্বর এমনকি অধিক লবণাক্ত অঞ্চলে হয়ে থাকে। লাগানোর পর ৪-৫ বছর পর থেকে খেজুর দেয়া শুরু হলে এক নাগাড়ে ১৫০ বছর অর্থাৎ বাঁচার আগ পর্যন্ত খেজুর দিয়ে থাকে। খেজুর খুবই পুষ্টিমান হওয়ার কারণে ১ কেজি খেজুর দেহকে ৩ হাজার ৪৭০ ক্যালরি শক্তি যোগান দেয়। খেজুরের গ্লুকোজ, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, তামা, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসকরবিক এসিডসহ নানা উপাদানে সমৃদ্ধ। খেজুর গাছ থেকে যেমন রস পাওয়া যায় তেমনি জ্বালানি হিসেবে পাওয়া যায় গাছের কাঠ। খেজুর গাছ লবণাক্ত এলাকা, নদী ভাঙন, কৃষি কাজের উপযোগী আবহাওয়া তৈরিতে সাহায্য করে। বর্তমান দেশের নদী ভাঙন রোধে, তাপমাত্রা কমাতে সর্বোপরি নতুন কৃষি ফসল সৌদির খেজুর গাছ হতে পারে দেশের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের মাধ্যম।
লেখক: মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, গোপালগঞ্জ নার্সারি, মো.পুর, ঢাকা-১২০৭
মন্তব্য চালু নেই