আলো কি জ্বলবে না ‘ভূতে ধরা’ দীপালির জীবনে?
মেয়েটির নাম দীপালি। নিজের নামের অর্থ তার কাছে এখন অর্থহীন। তার জীবনে যেন নিভে গেছে সুখের আলোকময় দীপ। সোনার কাকন হাতে, রূপার নূপুর পায়ে স্বামীর সংসারে হরিণীর মতো ছুটে চলার কথা যার। সেই দীপালি রানী এখন কুসংস্কারের ডাণ্ডাবেরি পায়ে বাড়ির উঠোনে পড়ে আছে।
ভূতের আছর হয়েছে বলে কিশোরী গৃহবধূ দীপালি রানীকে পায়ে লোহার ডাণ্ডাবেড়ি এবং শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতে সোনার চুড়ি, পরনে লাল শাড়ি, পায়ে রূপার নুপুর ও সেই সঙ্গে লোহার ডাণ্ডাবেড়ি লাগানো অবস্থায় মাটিতে শুয়ে থাকে সে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায়। কারো সঙ্গে কথা বলে না, শুধু চেয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। চারপাশের উৎসুক মানুষের ভিড়। কেউ বলে পাগল, আবার কেউ বলে, ভূত বা জ্বিনের আছর করেছে।
অপচিকিৎসার শিকার এই গৃহবধূকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে স্বামী তাকে রেখে গেছে বাবার বাড়িতে। এ ঘটনা ঘটেছে গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালীতে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার খামার চান্দের ভিটা গ্রামের বাসিন্দা সুশীল চন্দ্র। ভ্যান চালিয়ে রোজগার যা হয় তাতে সংসার চলে। বাড়ি বলতে দুটি ঘর। একটিতে থাকেন তার তিন মেয়ে রুপালী, সোনালী ও দীপালি। ছোটবেলা থেকে সে স্বাভাবিকভাবেই অন্য বোনদের মতো বেড়ে ওঠে গ্রামের পরিবেশে।
মেয়ের এ অবস্থা সম্পর্কে মা অমলা রানী জানায়, ২০০২ সালের শেষদিকে কিশোরী দীপালি রানী অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। কম কথা বলা, একা একা জোরে গান গাওয়া ও হঠাৎ করে বাড়ি থেকে রাস্তা দিয়ে দৌড় দেয় সে। মেয়ের এ অস্বাভাবিক আচরণ দেখে দরিদ্র ভ্যানচালক বাবা বেকায়দায় পড়ে যান। তাকে ঝাড়-ফুঁক দিতে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কবিরাজ বলেন, ‘দীপালির ওপর ভূতের আছর পড়েছে।’ তাই সেই থেকে শুরু হয় চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা। চলে ঝাড়-ফুঁক ও কবিরাজী ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা। কিন্তু তাতেও উন্নতি হয়নি তার।
এক পর্যায়ে বাবা সুশীল চন্দ্র কবিরাজের সঙ্গে পরামর্শ করেন। জ্বিন ও ভূত ছাড়ানো কবিরাজ তার কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। বিয়ের পর তার ওপর থেকে ভূতের আছর থাকবে না বলে জানায়। যেমন কথা তেমন কাজ। পাত্রের খোঁজ করা হয়। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে নইলে ভূতের আছর যাবে না। তাড়াহুড়ো করে চলতি বছর বৈশাখ মাসে সাঘাটা উপজেলার পুটিমারী গ্রামের গনেশ চন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের সময় দরিদ্র বাবা তার জামাইকে ২০ হাজার টাকা যৌতুকও দেন। বিয়ের পর প্রায় দুইমাস ভালোই কাটছিল দিপালী রানীর। কিন্তু এরই মধ্যে আবারও দীপালি রানী তার শ্বশুর বাড়িতে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে।
গত ১ আগস্ট দীপালির স্বামী গনেশ চন্দ্র ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার হাত-পা বেঁধে তার পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দেন। কোনো চিকিৎসা না করে দিয়ে যান বাবার বাড়িতে। তারপর স্বামী গনেশ তাকে রেখে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে যান।
দীপালির মা অমলা রানীসহ বাড়ির সবাই তার এ অবস্থা দেখে হতবাক। মেয়েকে জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর পায়নি। তাদের মনে হয়েছে আবার তার ওপর ভূতের আছর হয়েছে। ওই অবস্থায় দীপালি গতকাল বোয়ালী ইউনিয়নের খামার চান্দের ভিটা নামক স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে মাটিতে শুয়ে ছিল।
এলাকার লোকজন জানায়, দিপালীকে সুচিকিৎসা করলে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু আর্থিক সংগতি না থাকায় তার চিকিৎসা করাতে পারছে না দরিদ্র বাবা-মা। ঝাড়-ফুঁকের বদলে তাকে ভালো চিকিৎসা করালে দিপালীর অন্ধকার জীবনে আবার জ্বলে উঠবে সুখের দীপ। সবার প্রশ্ন দীপালির জীবনে কী আর আলো জ্বলবে না? এভাবেই শেষ হয়ে যাবে এক গৃহবধূর জীবন? আর এর জন্য হৃদয়বান মানুষের সহযোগিতার প্রত্যাশা পরিবারের।
মন্তব্য চালু নেই