‘২৪ বছর আগেই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে অংশ নেই’
এটা কি তবে ভুল, বিভ্রান্তি নাকি তথ্য বিভ্রাট? তা নিয়ে একটা ছোটখাটো বিতর্ক হতেই পারে। সে বিতর্ক যেমনই হোক, আর যে পক্ষই জিতুক- আসল সত্য হলো বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিক গেমসের কোনো ডিসিপ্লিনের নির্দিষ্ট ইভেন্টে কোয়ালিফাই করা প্রথম অলিম্পিয়ানের নাম কাজী শাহানা পারভিন।
এর আগে গত ২৪ ঘণ্টা স্থানীয় প্রচার মাধ্যমে গলফার সিদ্দিকুর রহমানকে সরাসরি অলিম্পিক গেমসে অংশ গ্রহণকারী প্রথম বাংলাদেশি বলা হয়েছে। তবে প্রকৃত তথ্য হলো, অলিম্পিক গেমসে প্রথম সরাসরি অংশগ্রহণের কৃতিত্বটা দেশবরেণ্য নারী শুটার কাজী শাহানা পারভিনের।
তিনি ১৯৯২ সালে বার্সিলোনা অলিম্পিক গেমসে সরাসরি অংশগ্রহণের ছাড়পত্র পান। সেটাও শুটিংয়ের এক বিশ্ব আসর ‘বিশ্বকাপ শুটিংয়ে।’ মঙ্গলবার জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে কাজী শাহানা পারভিন সে দাবিই করেন। তিনি বলেন, ‘গলফার সিদ্দিকুরও নিজ মেধা-যোগ্যতা বলে কোটা প্লেস করেই অলিম্পিক গলফের মূল পর্বে অংশগ্রহণের টিকিট নিশ্চিত করেছে; কিন্তু আমি এখন থেকে ২৪ বছর আগে ১৯৯২ সালে স্পেনের বার্সিলোনা অলিম্পিকে প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ হিসেবে এয়ার রাইফেল শুটিংয়ের মূল পর্বে অংশ নিই।’
ওই সময় কোয়ালিফাই স্কোর করেই অলিম্পিকে অংশ নিতে হতো জানিয়ে শাহানা পারভিন বলেন, ‘তখন অলিম্পিক শুটিংয়ের চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়ার একমাত্র পূর্বশর্তই ছিল অলিম্পিক কোয়ালিফাই স্কোর করা। সেটাও যেন-তেন আসর কিংবা কোন দেশের ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় হলে চলবে না। বিশ্ব শুটিংয়ের কোন মর্যাদাপূর্ণ আসর হতে হবে। আমি খুবই সৌভাগ্যবতী যে, তারও দুই বছর আগে, ১৯৯০ সালে সুইজারল্যান্ডসের জুরিখে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ শুটিংয়ে সেই কোয়ালিফাই স্কোর করে অলিম্পিকে অংশ নেয়ার শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হই।’
কাজী শাহানা পারভিন আরও জানান, তখন ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে অলিম্পিক কোয়ালিফাই স্কোর ছিল ৩৭৫। সুইজারল্যান্ডসের জুরিখে বিশ্বকাপ শুটিংয়ে ঠিক ওই স্কোর করেই তিনি কোয়ালিফাই করেন। অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কাজী শাহানার আবেগতাড়িত বক্তব্য, ‘বলে বোঝাতে পারবো না তখনকার অনুভূতি। বিশ্বাস করুন, আমার স্বপ্ন ও একান্ত ইচ্ছে ছিল অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করার। সে স্বপ্ন নিয়েই অনুশীলন করতাম। এক সময় স্বপ্ন হলো সত্য। যেদিন জানলাম, আমি অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করেছি, সেদিনের কথা ভুলবো না কোনদিন। কি যে অদ্ভুত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়েছিল মন।’
কোয়ালিফাই করার মুহূর্ত থেকে অলিস্পিক গেমস শুটিংয়ে তার ইভেন্টে অংশ নেয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন কাজী শাহানা পারভিন। তবে বলতে ভোলেননি, তাকে অনুশীলন করতে হয়েছে নানা বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে।
কারো বিরুদ্ধে এতটুকু অভিযোগ বা বিষোদগার না করে শুধু এটুকু বলেই থেমে গেছেন, ‘অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই মূল পর্বে অংশ নিতে পেরেছি। কাজেই পারফরম্যান্স তেমন ভালো হয়নি।’
তারপরও বিশ্বকাপ শুটিং থেকে ৪ পয়েন্ট বেশি স্কোর করেন। অলিম্পিকে তার স্কোর দাঁড়ায় ৩৭৯। মূল ইভেন্টে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে শাহানা পারভিন বলেন, ‘আমার ইভেন্ট ছিল গেমসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ঠিক পরদিন সকাল ৮টায়। যেহেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হবে রাতে। তাই আমি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিলে গেমস ভিলেজে ফিরতে ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে যাবে। তা জেনে বুঝেও আমি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেই। জাতীয় পতাকা অবশ্য আমার হাতে ছিল না। তারপরও মার্চপাস্টে আমিই ছিলাম বাংলাদেশের একমাত্র নারী ক্রীড়াবিদ। আমি কায়মনোবাক্যে সেটাই চেয়েছি। টিভির পর্দায় গোটা বিশ্ব দেখুক, বাংলাদেশের একজন নারী ক্রীড়াবিদ অলিম্পিক গেমসে অংশ নিচ্ছে, যা ছিল আমার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। আমার সন্তান তখন ছোট, পরিবার-পরিজন সবাই টেলিভিশনের পর্দায় আমাকে এক পলক দেখার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল। সেটাও অন্য ধরনের অনুভূতি।’
সত্যি সত্যিই মার্চপাস্ট ও বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর তার গেমস ভিলেজে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সে কথা জানিয়ে শাহানা পারভিন বলেন, ‘জানেন আমি রাত ২টায় ভিলেজে ফিরি। মাত্র ঘণ্টা চারেক ঘুমিয়ে ৬টায় উঠে সকাল ৭টার শার্টল বাসে চেপে শুটিং কমপ্লেক্সে যেতে হয়। প্র্যাকটিস তেমন ভালো হয়নি। তাই মূল পর্বে স্কোরও খুব বেশি ওঠেনি। তবে এটুকু বলতে পারি আমি প্র্যাকটিসে যেমন স্কোর করতাম। অলিম্পিকের চূড়ান্ত পর্বেও তেমনই করেছি। আমার স্কোর ছিল ৩৭৯। অবস্থান যদিও তেমন ভালো ছিল না।’
শাহানা পারভিনের কাছে অলিম্পিকে অংশগ্রহণের স্মৃতিটা অনেক বড়। সেটাই জানালেন তিনি, ‘তারপরও অলিম্পিকে অংশগ্রহণের স্মৃতিটাই আমার কাছে অনেক বড়। সত্যিই সে সুখ-স্মৃতি এখনো মনের আয়নায় জ্বল জ্বল করছে। আমার দেশের হয়ে প্রথম অলিম্পিকের মত মহা ক্রীড়া আসরে প্রথম কোন ইভেন্টের চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়ার কৃতিত্বটা আমার- তা ভাবতে সত্যিই খুব ভালো লাগে।’
মন্তব্য চালু নেই