গৌরবের ৯৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একশ বছর ছুঁই ছুঁই। এরপরও নিজস্ব আলোয় আলোকিত। নির্ভর করতে হয়নি কারো উপর। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় উদ্ভাসিত। নিজের গৌরব ও ঐতিহ্যে এখন গৌরবান্বিত। বাতিলের কাছে মাথা নত না করা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি রয়েছে বিশ্ব দরবারে। দীর্ঘ পথচলায় অর্জনও রয়েছে অনেক। দেশ মাতৃকারে দায়ী করে রেখেছে জন্মলগ্ন থেকে। পৃথিবীর মানচিত্রে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সবুজ শ্যামল ভূখণ্ডটির জন্মদাতা হিসেবেও একক নেতৃত্ব তার। বিশাল এ বসুন্ধরায় এমন প্রতিষ্ঠান আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যেটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম দেয়া থেকে শুরু করে তাকে একটি পতাকা উপহার দিতে পেরেছে।
বলা হচ্ছে প্রাচ্যের বাতিঘর হিসেবে খ্যাত দেশের ষোলো কোটি মানুষের স্বপ্নের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।
আজ ১ জুলাই। দেশ শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে অতিক্রম করেছে ৯৫টি সাফল্যের বছর। দেশের ক্রান্তিলগ্নে সোচ্চার থাকা এ বিদ্যাপীঠটির এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা।’ সম্প্রতি দেশে চলমান হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেই এ স্লোগান।
গৌরবোজ্জ্বল এ পথ চলায় নিজেকে করেছে তিন যুগের সাক্ষী। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। যৌবন ব্যয় হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৬-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-র গণ অভ্যুত্থান, ৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ১/১১ সরকারের পতনের আন্দোলনে। দেশের সব আন্দোলন সংগ্রামের মূল নেতৃত্ব দেয়া হয় এখান থেকে। যখনই জাতির ক্রান্তিলগ্ন শুরু হয় তখনই সোচ্চার থেকেছে এ বিদ্যাপীঠ। তাইতো সম্প্রতি চলমান হত্যাকাণ্ডের কথা মাথায় রেখে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ।
কীর্তিমান লেখক আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির যা কিছু আশা-ভরসার, তার সবটাই তো ধারণ করে এই (ঢাকা) বিশ্ববিদ্যালয়।’
ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার জমিদার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নির্দেশে ১৯১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে নাথান কমিটি গঠন করা হয়। সুদীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ৬০০ একর জমি নিয়ে মনোরম পরিবেশে বিশাল তরুছায়া সুনিবিড় পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। যদিও এখন কমতে কমতে এর আয়তন দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৬০ একরে। ব্রিটিশরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে এর পঠন-পাঠন ও শিক্ষাদান কার্যক্রম পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন বলেই এটিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো।
এরপর থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার খ্যাতিতে এই উপমহাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাদান, বিদ্যাচর্চা, শিক্ষকদের গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের খ্যাতি শুধু এ উপমহাদেশে নয়, অর্জনের প্রভাব পড়ে পূর্ব বাংলা পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ নানা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও।
অন্যদিকে এর আবাসিক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল উপমহাদেশের প্রাচীনতম এবং তৎকালীন শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন, পাঠ নেবেন ও জ্ঞানার্জনের নানা প্রয়োজনে লাইব্রেরিসহ শিক্ষকের সাহচর্য লাভ করবেন।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে তিনটি অনুষদ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা করলেও বর্তমানে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩টি। ১২টি বিভাগ থেকে এখন ৮১টি বিভাগ চালু রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ১১টি ইনস্টিটিউট, ৪৯টি গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র। সূচনাকালে এর আবাসিক হল ছিল তিনটি। বর্তমানে ৫টি ছাত্রী হলসহ সর্বমোট হল সংখ্যা ১৯টি। এছাড়াও রয়েছে একটি ছাত্রীনিবাস ও পাঁচটি হোস্টেল।
প্রতিষ্ঠাকালে শিক্ষক ছিলেন মাত্র ৬০ জন। বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা এক হাজার ৯৫৫ জন। ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা করেছিল আজ তার শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩১ হাজার ৯৫৫ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা রয়েছেন এক হাজার ৯২ জন, ৩য় শ্রেণির কর্মচারী এক হাজার ১৩৭ জন ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রয়েছের দুই হাজার ২০৫ জন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত ঢাবি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এক হাজার ৩৮৭ জন আর এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছেন এক হাজার ৩৩৮ জন।
সুদীর্ঘ ৯৫ পেরিয়ে ৯৬ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশকে দিয়েছে অনেক কিছু। দিয়েছে দেশ-বিদেশে অনেক খ্যাতি ও গৌরব। অর্জন করেছে অনেক দুর্লভ সম্মান। তৈরি করেছে দেশ-বিদেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান পণ্ডিত ও গবেষক। আজ দেশটির রাজনীতি, প্রশাসন থেকে শুরু করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা।
মন্তব্য চালু নেই