টেকনাফে কারা এই বিদেশী নাগরিক? আতংকিত জনগণ, অস্থির পুলিশ
জামাল জাহেদ, ককসবাজার: টেকনাফ সীমান্তের সাগর পাড়ের বাহারছড়া ইউনিয়নের অরণ্যঘেরা একটি মাদ্রাসায় একদল বিদেশী নাগরিকের রহস্যজনক আচরণে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তের ওই অরণ্যঘেরা এলাকায় বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে যে বিদেশী নাগরিকের দলটি আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা মোহাম্মদ আজিজের ঘরে- তাদের সন্ধান এখনো মিলেনি।
তারা কি টেকনাফ-উখিয়ার কোন রোহিঙ্গা শিবিরে, কোন এনজিও বা স্থানীয় প্রভাবশালীর আশ্রয়ে রয়েছেন? পুলিশের সন্দেহ, বিদেশীরা টেকনাফ থেকে উখিয়ার কোন স্থানে আত্বগোপন করে থাকতে পারেন। এসব বিদেশীরা প্রকৃতপক্ষে কোন দেশের নাগরিক সেটাও নিশ্চিত করা যায়নি। তবে কেও বলে তুরষ্কের আবার কেও বলে পাকিস্তানের নাগরিক তারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বাংলাদেশের সাথে দেশ দুইটির সাম্প্রতিক সময়ের কূটনৈতিক সর্ম্পক নিয়ে যেখানে দৃশ্যমান টানাপোড়েন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেখানে তাদের এরকম ‘গোপন তৎপরতা’ নিয়ে এলাকার লোকজন সন্দেহের চোখে দেখছেন।
এমনকি কক্সবাজারের প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারি সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থার অগোচরে এসব বিদেশী নাগরিকের সীমান্তবর্তী ষ্পর্শকাতর এলাকায় আনাগোনার বিষয়টি রিতীমত উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে স্থানীয় সচেতন মহলেও । সেই সাথে সীমান্তে গত কয়েকদিন ধরে একই স্থানে বিদেশী নাগরিকদের আনাগোনার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের নজরে না থাকার ব্যাপার নিয়েও উঠেছে নানা কথা। অনুরুপ আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যদেরও চোখ ফাঁকি দিয়ে বিদেশীরা কিভাবে এমন এলাকায় গিয়ে পৌছেন। কেননা গত ১২ মে দিবাগত রাতে টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে জঙ্গী রোহিঙ্গারা একজন আনসার কমান্ডারকে হত্যার পর লুঠ করে নেয় ১১ টি অস্ত্র ও ৬৭০ রাউন্ড গুলি।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ সাখাওয়াত হোসেন গতকাল বৃহষ্পতিবার এ প্রসঙ্গে বলেন-‘টেকনাফ সীমান্তের এমন একটি এলাকায় এরকম বিদেশীদের সন্দেহজনক আনাগোনার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।’ কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ারুল নাসের জানান-‘দেশী-বিদেশী এনজিওর ত্রাণ সামগ্রী বন্টনের জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু এরকম কোন অনুমতি নেই। এছাড়াও এনজিও ব্যুরোর অনুমতি ছাড়া কোন ত্রাণ বিলি করতে পারবে না।
তদুপরি সীমান্তে বিদেশী নাগরিকদের আনাগোনার বিষয়টি দেখার জন্য টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দ্দেশ দিয়েছি।’ টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ সফিউল ইসলাম এ বিষয়ে বলেছেন-‘বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আমাকে জানান-সেখানে কতিপয় বিদেশী গিয়েছিলেন তবে তারা পরে কোথায় নাকি চলে গেছেন তা তিনি (চেয়ারম্যান) জানেন না।’ টেকনাফ-উখিয়া সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল মালেক মিয়া জানান-‘সীমান্তে বিদেশীদের কোন কারনে যাওয়া দরকার হলে আমরাই তাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। কিন্তু এরকম বিদেশীদের আসার ব্যাপারে আমাদের জানানো হয়নি। একারনেই পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালিয়েছে।’
বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ পরিদর্শক রিপন কুমার দাশ গতকাল বলেন-‘বিদেশী নাগরিকের উপস্থিতি শুনে বুধবার সন্ধ্যায় আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। এসময় পুলিশ দেখে স্থানীয়দের সাথে বিদেশীরাও দৌঁড়াতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিদেশী নাগরিকরা চেয়ারম্যান বাড়ীতে (মওলানা আজিজের বাড়ী) ঢুকে পড়েন।’
পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, বিদেশীদের সাথে আলাপের চেষ্টা করা হলে ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা আজিজ তার সাথে দুর্ব্যবহার করেন ও সরকারি কাজে প্রচন্ড বাঁধা প্রদান করেন। এ ব্যাপারে তিনি ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জিডি লিপিবদ্ধ করবেন বলেও জানান। বুধবার রাতেই পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বিদেশীরা চেয়ারম্যানের বাড়ী থেকে কোথায় গেছেন তা জানেন না তদন্ত কেন্দের এই কর্মকর্তা। তবে তিনি সন্দেহ করছেন-এসব বিদেশীরা উখিয়ার কোন রোহিঙ্গা শিবির বা অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের অরণ্যঘেরা এলাকায় ‘আনাছ বিন মালেক’ নামের একটি মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং একই ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান মওলানা মোহাম্মদ আজিজ।
টেকনাফ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর অবস্থান হচ্ছে বাহারছড়া ইউনিয়নে। রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগটন আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উক্ত মাদ্রাসা কেন্দ্রিক জঙ্গী কর্মকান্ড চলে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এরকম অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বছর পুলিশ মাদ্রাসাটিতে অভিযানও চালিয়েছিল।
অভিযোগ উঠেছে, বাহারছড়া ইউনিয়নে গোপনে জঙ্গী কর্মকান্ডের নেপথ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারাই জড়িত রয়েছেন। কিন্তু এলাকার লোকজন ভয়ে এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিজের পরিচয়ে কিছুই জানাতে চান না। তবে বিদেশী নাগরিকদের এলাকাটিতে আনাগোনা চলছে গত সপ্তাহ জুড়ে। প্রতক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত ২০ জুন ইফতারের সময় বাহারছড়ার উক্ত মাদ্রাসাটিতে কয়েক মণ চালের বিরিয়ানি বিলি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয়দেরও এই বিরিয়ানি দেয়া হয়। একই রাতে নগদ টাকাও বিলি করা হয়েছে। এসবও তদারকি করেছেন কয়েকজন বিদেশী নাগরিক। বাহারছড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা মওলানা মোহাম্মদ আজিজ এবং ইউনিয়ন যুবলীগের সহ সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার মোহাম্মদ ইউনুছ বিদেশীদের প্রদত্ত এসব ত্রাণ বিলি করেন বলে জানা গেছে। দিনের বেলায় নয় কেবল রাতেই ত্রাণ বিলি করা হয়। জনপ্রতি এক হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার নগদ টাকা সহ অন্যান্য পণ্য সামগ্রীও দেয়া হয়। এসব বিষয়ে জানার জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মওলানা আজিজের মোবাইলে বহুবার চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল রিসিভড করেননি। অপরদিকে যুবলীগ নেতা ইউনুছ দাবী করেন-‘এমন খারাপ কোন কাজ এখানে হচ্ছে না।’
সাবেক দলীয় এমপি ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী গতকাল জানান-‘দেশের চলমান এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তের গহীন অরণ্য এলাকায় এসব বিদেশীদের আনাগোনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিদেশীরা প্রকাশ্যে দিনের বেলায় না এসে এরকম রাতের বেলায় জঙ্গী কর্মকান্ড সম্পৃত্ত মাদ্রাসায় কি কাজটি পরিচালনা করছেন সেসব গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা প্রয়োজন।’
সাবেক এমপি বলেন, আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে বাহারছড়া এলাকায় যেসব স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মী এরকম গোপন কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপও নেয়া দরকার। গত কয়েকদিন ধরেই এলাকায় বিদেশী নাগরিকদের আনাগোনায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এলাকার লোকজনের অভিযোগ-বাহারছড়া ইউনিয়নের জঙ্গী সম্পৃত্ত কতিপয় লোক ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ার সুযোগ নিয়ে এলাকায় গোপন তৎপরতার একটি ডেরা স্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মন্তব্য চালু নেই