লাউয়াছড়া উদ্যানে রেল লাইন থাকবে, না গাছ থাকবে?
জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশের আয়তনের তুলনায় এ প্রাচুর্য ঈর্ষণীয়। জীব বৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বন্যপ্রাণী। বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এই বন্যপ্রাণীরা পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপ, সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব, অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যায় বনজ সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, আবাসস্থল ধ্বংস, বন্যপ্রাণী শিকার ও হত্যা এবং সময়োপযোগী টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে অতীতের সমৃদ্ধ বন্যপ্রাণীর অবস্থা আজ নাজুক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে আমাদের দেশ থেকে ১৪ টি প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে আবাসস্থলের খন্ডায়ন, পরিবর্তন ও বন্যপ্রাণী চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে মারাত্মক ভাবে। তাদের চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি সহ রেলের বিকট শব্দের কারণে প্রজননে বিঘœ সৃষ্টি জনিত কারণে জীনগত দিক থেকেও প্রজাতিরা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এতকিছু প্রতিকূলতার মাঝে ও বাংলাদেশের জীব বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল সমূহের মধ্যে যে সকল অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণী বেঁচে আছে তাদের অন্যতম নিরাপদ আবাসস্থল হল “লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান”।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন নংPBM(S-3)7/96/367 Dated July, 07, 1996 মুলে প্রটেক্টেড এলাকা হিসেবে ঘোষিত করা হয়। জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধশালী প্রোটেকটেড এলাকাগুলোর মধ্যে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ মোঃ আরমান হোসেন স্বাক্ষরিত ০৯/০৪/২০১৬ তারিখের পত্র নং ৫৪.০১.০০০০.২০৮.০৫.০২২.১৩-১১৩ পত্র দিয়ে জানান যে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত রেল লাইনের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের কিঃমিঃ ২৯৩/১ হতে ২৯৮/১ পর্যন্ত ৫ (পাঁচ) কিলোমিটার এর মধ্যে নির্বিঘ্নে ট্রেন চলাচলের জন্য ও দুর্ঘটনা এড়াতে উক্ত রেল লাইনের উভয়পার্শে¦র নূন্যতম ৫০ ফুট পর্যন্ত এলাকার গাছ-পালা কাটতে হবে।
চিঠি’র জবাবে বন্যপ্রাণী বিভাগ জানান যে, আমাদের জরিপে দেখা যায় পাঁচ বৎসর বয়স হতে শুরু করে শত বৎসর বা তার অধিক বয়সের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কর্তন করা প্রয়োজন। এছাড়া, উক্ত এলাকার প্রতি এক বর্গমিটার এলাকাতে প্রায় ২০ টি সিডলিং (চারা) এবং লতা-পাতা/ঝোপ ঝাড়/ঘাস বিদ্যমান, যেটা ছোট-ছোট বন্যপ্রাণীর আবাস-স্থল। বিদ্যমান রেল লাইনের উভয়পাশে প্রায় ২৫ হাজার এর অধিক গাছ কর্তন করা হলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করাসহ জীব বৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ মৌলভীবাজার জেলার সহকারী বন সংরক্ষক মো: তবিবুর রহমান বলেন, নানা প্রতিকূলতার মাঝে ও বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল সমূহের মধ্যে যে সকল অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণী বেঁচে আছে তাদের অন্যতম স্থান হচ্ছে ”লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান”। ঐ চিঠির প্রেক্ষিতে আমরা জরিপ করে আমাদের জবাব জানিয়ে দিয়েছি। এই চিঠির মানে এই বুঝাচ্ছে এলাকায় অবস্থিত সকল গাছ কর্তন মানে প্রায় ২৫০০০ টি জীবন্ত ফলজ,বনজ ও ঔষধি এবং লক্ষাধিক ছোট্ট ছোট্ট চারা গাছের অকাল মৃত্যু এবং বন্য প্রাণীর আবাস-স্থল ধ্বংস ছাড়া কিছুই না।
তিনি আরো বলেন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের স্বার্থে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কোর জোনের মধ্য দিয়ে ধাবমান রেল লাইনের উভয়পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট এলাকার ভিতরের গাছ-পালা কর্তন করা নিষ্প্রয়োজন।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাণকেন্দ্রের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত রেল লাইনের উভয় পার্শ্বের নির্জন পরিবেশ হাজারো গাছ-গাছালী, লতা-পাতা, ঝোপ-ঝাড়ের বিপুল সমারোহ সত্যিকার অর্থে বন্যপ্রাণীর স্বর্গ, যে স্বর্গীয় পরিবেশ উদ্যানের ১২৫০.০ হেক্টর এলাকার আর কোথা ও দৃশ্যমান হবে না।
অপর দিকে একই চিঠিতে জানানো হয়েছে যে, রশিদপুর-সাতগাঁও সেকশনের কিঃমিঃ ২৭১/২-২৭৯/৭ পর্যন্ত উভয় দিকের ৫০ ফুট গাছ কর্তন করার জন্য।
এব্যাপারে বন্যপ্রাণী বিভাগ জানায়, এই এলাকার রেল লাইনের পাশে সামাজিক বনায়নের আওতায় সৃজিত বাগানটি সিলেট বন বিভাগের আওতাভুক্ত। আবর্তনকাল উত্তীর্ণ হওয়ায় সিলেট বন বিভাগের উক্ত গাছ সিলেট বন বিভাগ কর্তৃক নিলামে বিক্রয়ের মাধ্যমে কর্তনের কাজ চলমান রয়েছে।
চিঠিতে আরমান হোসেন জানান, ঢাকা-সিলেট রেললাইনের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ কিলোমিটারের পাহাড়ি এলাকায় ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ও ভেঙে রেললাইনের ওপর পড়ছে। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ও যাত্রীসাধারণের প্রাণহানি ঘটতে পারে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ২১ এপ্রিল রাতে ঝড়ে ৩০-৩৫টি গাছ রেললাইনের ওপর ভেঙে পড়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। এ ছাড়া চলতি বছরের ৭ এপ্রিল রাতে ঝড়ে আরও ৩০টির মতো গাছ রেললাইনের ওপর পড়ে। এতে উপবন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের একটি হেডলাইট ভেঙে যায় ও ট্রেনটি আটকা পড়ে। এ অবস্থায় উদ্যান এলাকার রেললাইনের উভয় পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটতে হবে। একইভাবে রেললাইনের রশিদপুর-সাতগাঁও বিভাগের ২৭১/২ থেকে ২৭৯/৭ কিলোমিটার পর্যন্ত উভয় পাশের গাছও কাটতে হবে। নইলে পরবর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ অ্যাক্ট, ১৮৯০’-এর ১২৮ ধারা মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বন্যপ্রাণী বিভাগ থেকে রেলওয়ে বিভাগকে পাঠানো উপরোক্ত চিঠির জবাবে রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আরমান হোসেন স্বাক্ষরিত পত্র নং- ৫৪.০১.০০০০.২০৮.০৫.০০২.১৩ ১৮/০৫/২০১৬ তারিখের পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করে বলেন, একাধিকপত্রের মাধ্যমে পত্রের মাধ্যমে রশিদপুর-সাতগাঁও এবং শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ রেল সেকশনের পাহাড়ি অংশের রেলপথের উভয় পাশে গাছপালা কর্তনের অনুরোধ জানানো হলেও অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অথচ উক্ত সেকশন সমূহে প্রায়ই ঝড়ো বাতাসে গাছপালা ভেঙ্গে রেল পথের উপর পড়ে রেলপথ অবরুদ্ধ করে ফেলছে। ফলে ট্রেন দুর্ঘটনার আশংকা সৃষ্টি হচ্ছে এবং ট্রেনে ভ্রমণকারী যাত্রী সাধারণের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ট্রেনে ভ্রমণকারী সম্মানিত যাত্রী সাধারণের জীবনের নিরাপত্তা বিধানকল্পে রেলগাড়ি চলাচলে বিপদ বা বিঘœ সৃষ্টিকারী বৃক্ষ অপসারণে রেল কর্তৃপক্ষ “দি রেলওয়েজ এ্যাক্ট, ১৮৯০” এর ধারা ১৫ মোতাবেক পূর্ণ ক্ষমতাবান। কাজেই আপনি যদি আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে রেলপথের উভয় পার্শ্বে ঝুঁকিপূর্ণ গাছ সমূহ অপসারণে কার্যকরী উদ্যোগ না গ্রহণ করেন তাহলে “দি রেলওয়ে এ্যাক্ট, ১৮৯০” এর ধারা ১৫ এর ক্ষমতাবলে জনস্বার্থে ও সম্মানিত যাত্রী সাধারণের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে রেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উক্ত গাছ সমূহ কর্তন করে অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এব্যাপারে বন্যপ্রাণী বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মিহির কুমার দো বলেন, উনারা চিঠিতে উল্লেখ করে বলেছেন যে গত ০৭/০৪/২০১৬ তারিখে দিবাগত রাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে রেললাইনের উপর ৩০টি গাছ পতিত হওয়ার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে অতিরঞ্জিত। কারণ ঝড়ের প্রভাবে লাইয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে ২৯৩/৫-৬ পয়েন্টে ১টি বনাক গাছ, ২৯৩/৮-৯ পয়েন্টে ১টি শিমুল গাছ এবং ২৯৪/১-২ পয়েন্টে ১টি লালী গাছ ভেঙ্গে পড়ে। এরমধ্যে বনাক গাছের কারণে উপবন ট্রেনটি আটকা পড়ে। তবে আমি মনে করি এই চিঠি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর চিঠি। এটি বাস্তবায়ন হলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যোগ হুমকির মুখে পড়বে।
ঢাকা রেলওয়ে বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ মো: আরমান হোসেন বলেন, রেল লাইনের উভয়পাশে ঝুঁকি পূর্ণভাবে কিছু গাছ হেলে পড়েছে। সেগুলো প্রাথমিকভাবে আমরা কর্তনের চেষ্টা করেছিলাম। সেই জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আমরা নির্দেশে বন বিভাগকে চিঠি দিয়েছি। আমাদের গাছ কাটা লোকবল নাই। সেই জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। লোকবলের অনুমোদন পেলেই আমরা সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিবো।
মন্তব্য চালু নেই