ব্যাগ হাতে ফাটাকেষ্টকে দেখেই হতবাক!
সাধারন মানুষের সঙ্গে বাজার করলেন সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের
রাতে ঘুম হয়নি সবজি বিক্রেতা শওকত আর রাসেলের। গোটা রাতই কেটেছে টান টান উত্তেজনায়। দুজনেরই চোখে ছিলো ভোরের অপেক্ষা। তবে দিনের শুরুটাই হয় অন্যান্য দিনের চেয়ে আলাদাভাবে। আজ ভোর না হতেই তারা চলে আসেন দোকানে।
আগেভাগেই দোকানের ঝাঁপ খুলে শুরু করেন বেচাবিক্রি। ক্রেতাদের চেয়ে পড়শি ব্যবসায়ীদের ভিড়টাই বাড়তে থাকে ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে।
তাদের কাছে বেশ গর্বের সঙ্গেই আগের রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন তারা।
দুপুর পর্যন্ত দেখা গেলো এই জটলা। সেই ভিড় ঠেলে জটলার কারণটা জানার চেষ্টা করতেই সেখানে থাকা পাশের দোকানি রতন বাংলানিউজকে বলেন, হ্যাগো দুইজনের থন কাইল রাইতে মন্ত্রী ফাটাকেষ্ট সবজি কিনছে, হেই গল্পই হগ্গলতেরে শুনাইতেছে।
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের কাঁচামালের ব্যবসায়ীদের মাঝে শওকত আর রাসেলের এখন তারকা খ্যাতি।
রাজধানীতে ফেরার পথে গত শুক্রবার রাতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ব্যাগ হাতে আম জনতার মতোই সওদা করেছিলেন এই দুজনের কাছ থেকে।
বিরামহীনভাবে সেই কথা ভোর থেকেই অন্যদের শুনিয়ে আসছে শওকত ও রাসেল।
গল্পটা ছিলো ঠিক এমন- রাতে পতাকাবাহী একটি গাড়ি থামলো দোকানের সামনে। গাড়ি থেকে গেঞ্জি পরিহিত মানুষটিকে বহুবার দেখছি টিভির পর্দা আর খবরের কাগজে।
সেই মানুষটি বাজারে পা রেখেই কিনলেন ব্যাগ। তারপর দুই দোকানির কাছ থেকে একে একে সওদা নিয়ে ভরলেন বাজারের থলে।
মন্ত্রীর সঙ্গে দরদাম করা, পছন্দের সবজিগুলো একে একে থলেতে ভরে দেয়া এসব স্মৃতিই এখন দোলা দিচ্ছে তাদের মনে।
আর বাড়তি পাওনা হিসেবে মন্ত্রীর হাত থেকে নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ মূল্য পাওয়ার খবরটিই যেন ওই বাজারে তাদের এনে দিয়েছে তারকা খ্যাতি।
সবাই এসে একে একে জানতে চাইছে কি কি সওদা করলেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঠিকঠাক মতো দাম বলেছিলো কিনা ইত্যাদি।
বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় শাক বিক্রেতা রাসেলের।
মন্ত্রী ফাটাকেষ্ট আমার দোকানে আইসা হগল ধরনের শাক কিনলো। লাউ শাক, কুমড়া শাক, ডাঁটা শাক, বাদ রাখেনি কিছুই। বুঝলাম তিনি শাক পছন্দ করেন-বিরামহীন ভাবেই এ কথা বলছিলেন রাসেল।
তবে শওকতের অভিজ্ঞতা অন্য রকমের। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, হেরে সামনে পাইয়া চোখে ডলা দিলাম। আসলেই ফাটাকেষ্ট মন্ত্রীরে দেখতাছি নাকি। যহন দামদর জিগাইলো তখন চেহারার দিকে আর না তাকাইয়া পাল্লা পাত্থর নিয়া মাপন শুরু করলাম। মিষ্টি কুমড়া, শশা, শিম, মুলা, টমেটো, বাধা কপি, ধনে পাতা, লাউ ইত্যাদি সবজি দিয়ে ভরে দিলাম মন্ত্রীর বাজারের থলে।
এখনো মনে হয় সব কিছুই স্বপ্নের মতোন! যোগ করেন শওকত।
এরই মাঝে পাশের দোকানি কবির নিজে থেকেই বাংলানিউজকে বলেন, মন্ত্রী সবার আগে আমার থন চাইরটা ব্যাগ কিনছে।
তিন দোকানির কাছ থেকে সাড়ে সাতশ’ টাকার সদাই করে মন্ত্রী দেড় হাজার টাকা দিতেই অবশিষ্ট টাকা ফিরিয়ে দিতে চান ব্যবসায়ীরা।
মন্ত্রী বলেন, তোমরা নায্য দাম রেখেছো, তাই খুশি হয়ে বাকী টাকাগুলো তোমাদের বখশিশ।
তবে এ সময় মহাসড়কের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা না করার পরামর্শও দেন মন্ত্রী।
পরে মন্ত্রী সোজা চলে যান মাছের বাজারে। সেখানে বেশ ছোট আকৃতির কেজি পরিমাণ দেশি কই কিনে ৬শ’ টাকার স্থলে গণেশ রাজবংশী নামের বিক্রেতাকে দেন ৮শ’ টাকা।
এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক ফরহাদ হায়দার। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, মন্ত্রীর প্রটোকলে নিয়োজিত থাকতেই দেখি সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে তার গাড়ি থামলো। নিজেই বাজার করলেন। এটা দেখে অনেকেই মতো আমিও অবাক হয়েছি। মন্ত্রীকে দেখতে বেশ জটলাও তৈরি হয় সেখানে। তবে বাজার শেষে মন্ত্রী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বলে যান, তোমরা কেউ ফুটপাতে বসো না। সবমিলিয়ে আমার জন্যে এটা ছিলো একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।
সেখানে থাকা এক বেসরকারি টেলিভিশনের সাভার প্রতিনিধি নজমুল হুদা শাহীন বাংলানিউজকে বলেন, মন্ত্রী নিজে থলে হাতে বাজারে নেমেছে- এ খবর শুনেই সেখানে ছুটে যাই। দামদর করে প্রতিটি পণ্য কেনার বিষয়টি আমার কাছে অন্যরকমই লেগেছে।
অন্যান্য দেশে প্রচলিত হলেও আমাদের দেশে মন্ত্রীদের বাজারের থলে হাতে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়না। নিরাপত্তা, খ্যাতির বিড়ম্বনাসহ নানা কারণে তারা সাধারণ জনতার কাতারে নামতে চাইলেও পারেন না। আর সেটা পারেন না বলেই অনেকে জনগণের আশা আকাঙ্খার বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারেন না। তবে ব্যতিক্রম দেখলাম সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীকে- যোগ করেন নজমুল হুদা শাহীন নামের এই গণমাধ্যম কর্মী।
তবে এ দৃশ্য ধারণ করা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার সৈকত খন্দকার বাংলানিউজকে বলেন,এটা ছিলো আমার কাছেও ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা। হাজারো ছবি তুললেও মন্ত্রী নিজে ব্যাগ হাতে বাজারে নেমেছেন এই ছবি তুলতে ভুল হয়নি মোটেও।
বাজারের ব্যাগ হাতে সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে যাওয়া। মন্ত্রী হয়েও দরদাম করে বাজার করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো? এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মানিকগঞ্জ থেকে ফেরার পথে গিন্নীকে ফোন করলাম, বাসায় বাজার টাজার আছে কিনা।
যে ফর্দ দিলো তার সবই নিজে হাতে কিনলাম। আমাকে মনে রাখতে হবে আমিও সাধারণ জনতার একজন। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। রাতের আহার সেরেছি কই মাছ আর সাভার থেকে কেনা সবজি দিয়ে। এ সময় সচরাচর যারা বাজার করেন তাদের জিজ্ঞাস করে দরদাম মিলিয়ে দেখলাম, সাভারে মাছ আর সবজির দাম রাজধানীর বাজারের তুলনায় সস্তা।
মন্তব্য চালু নেই