একধিক বিয়ে করাই যার নেশা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোমল ও তামান্না, বরিশালের নিশাত, ঢাকার মিতু। শুধু এই চারজনই নয়, ক্যারিয়ার গড়ার ফাঁদে সর্বনাশ হয়েছে আরো অনেকের। হতেই চলেছে সর্বনাশ কারো না কারো। বিদেশ যাবে, বিমানবালা হবে হরেক স্বপ্নের হাতছানিতে সব হারিয়েছে তারা। ঘটনার পাকে বিতাড়িত হতে হয়েছে পরিবার থেকে। ভয়ঙ্কর এক প্রতারকের বিয়ে বিয়ে খেলা চুরমার করে দিয়েছে তাদের স্বপ্ন। সিরিজ বিয়ের এই নায়ক মো. রাজিব হাসান। হাল পরিচয় তিনি রাজিব’স নামের একটি কোচিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে রাজিব’স এর শাখা। ঘটনার শিকার তরুণীরা বলছেন এই কোচিংয়েই এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ পাতা আছে। কোচিংয়ে আসা শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের জালে বেঁধে ফেলে সে। এভাবেই একের পর এক বিয়ে করে চলেছেন রাজিব নামের এই ইংরেজি বিশারদ। রাজিব হাসানের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় প্রতারণার শিকার সাবিকুন নাহার কোমল (২৭) নামে তার এক স্ত্রী মামলাও করেছেন। ২০১৫ সালের ২৬শে জানুয়ারি এই মামলাটি করা হয়।
এই মামলায় তাকে অভিযুক্ত করে আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। রাজিব পাবনার সুজানগর উপজেলার দুলাই গ্রামের মো. মন্তাজ উদ্দিনের ছেলে। মামলায় রাজিবের পিতা মন্তাজ উদ্দিন, মা রহিমা বেগম এবং বোন হাসি আক্তার, তার স্বামী মো. কবির ও বড় ভাই রানা হাসানকে আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের নাম অভিযোগপত্রে বাদ দিয়েছে। তবে কোমল বলেন, এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই রাজিব এসব অপকর্ম করছে। সবকটি বিয়ের খবরই জানেন তার বাবা-মা। তারা দফায় দফায় নতুন বৌ বরণ করে চলেছেন। কোমলের মামলার এজাহারে বলা হয়- রাজিব হাসান বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণা করে একাধিক নারীকে বিয়ে করেন। কখনো বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি ইংরেজি ভাষা শিক্ষা একটি কোচিং সেন্টারের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় একটানা ৬/৭ মাস অবস্থান করে ইংরেজি শিক্ষার ক্লাস নেন।
সে সময়ে টার্গেটকৃত শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য জেনে নেন। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তা দেবে বলে সম্পর্কের সূচনা করে। ভালোবাসার অভিনয় করে মন কেড়ে নেন। সম্পর্ক গড়ায় আরো দূর। বিয়েতে যার শেষ। কোমলের মামলার এজাহারে তাকে সহ ৪ জনকে বিয়ে করার কথা বলা হয়েছে। ২০০৭ সালে ঢাকার মহাখালীর নাজমা আক্তার মিতুকে বিয়ে করেন। তাকে ঘরে রেখেই ২০১০ সালে বিয়ে করেন নাসিরনগরের তামান্না আক্তারকে। ২০১২ সালে বরিশালের নুসরাত নিশাতকে। আর ২০১৪ সালে সাবিকুন নাহার কোমলকে। মিতুকে তালাক দেন ২০১৩ সালে। মিতুকে বিয়ে করার আগে তার সম্পর্ক ছিল আরো এক মেয়ের সঙ্গে। যে ছিল তার ফার্মাসি শিক্ষার ক্লাস মেট।
এজাহারে কোমল বলেন, তিনি ওই কোচিংয়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখানে কয়েকদিন ক্লাস করার পরই তার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজিবের। তারপর থেকে ক্লাসে ও মোবাইল ফোনে শিক্ষকের অধিকার নিয়ে আলাপ জমিয়ে তুলে তার সঙ্গে। প্রতারণামূলক নানা কথাবার্তায় সে তার কাছে নিজেকে একজন সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে বলে আমাকে ছাড়া তার জীবন অচল। নানা অভিনয় করে সে আমাকে বিয়েতে রাজি করায়। তারপর বরিশাল নিয়ে গিয়ে ২০১৪ সালের ২৬শে জানুয়ারি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে আমাকে বিয়ে করে। বিয়ের পর আমাকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসে রাজিব। তখন আমার ভাই বিয়ের কাগজপত্র দেখার সময় এফিডেভিটটি ভুয়া বলে বুঝতে পারেন। পরদিন আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এফিডেভিট করা হয়। বিয়েতে ১৫ লাখ টাকা দেনমোহর ধরা হয়। বরিশালে করা এফিডেভিটে ৩ লাখ টাকা উসুল দেখানো হয়েছিল। বিয়ের ৩ মাসের মাথায় স্বপ্ন ভঙ্গ হয় কোমলের। জানতে পারে রাজিবের স্ত্রী আছে আরো একাধিক। এই খবর জানার পর ২০১৪ সালের ৭ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কোমলের মা জোসনা বেগম। কোমলের দায়ের করা মামলা বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল আদালতে বিচারাধীন।
রাজিবের ফাঁদে পড়ে ক্লাস টেনের ছাত্রী মিতু। তার হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ২০০৭ সালের ঘটনা এটি। ২০০৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি রাজিবের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তিন লাখ টাকা দেনমোহর ধরা হয় বিয়েতে। ঢাকার মগবাজার কাজী অফিসে বিয়ে হয় তাদের। কয়েক বছরের নানা ঘটনা প্রবাহে রাজিবের সঙ্গে সম্পর্কের ইতিঘটে মিতুর। মিতুর গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। রাজিব হাসান ফার্মাসিস্ট হিসেবে সরকারি চাকরি পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর সরকারি হাসপাতালে পোস্টিং পান। সেখানে তামান্না আক্তারকে বিয়ে করেন। তামান্না স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। রাজিবের খপ্পরে মেয়ের এমন দশায় তামান্নার বাবাও মারা যান। নাসিরনগরে চাকরি করার সময়ই সে একটি কোচিংয়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখায় ক্লাস নেয়া শুরু করে। সেখানে পটিয়ে ফেলে কোমলকে।
২০১২ সালের শেষ দিকে আরব আমিরাত এয়ার লাইন্সে চাকরি হয় কোমলের। কিন্তু সেই চাকরিতে যেতে দেয়নি রাজিব। কোমল বলেন, ৪ জনকে বিয়ে করা ছাড়াও আরো অনেক মেয়ের সঙ্গে রয়েছে তার বিয়ে বিয়ে সম্পর্ক। আনমেরিড বলে সে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্যারি করে যাচ্ছে। সে আই ই এল টি এস শেখায়। অসংখ্য মেয়ে ভর্তি হয় তার ওখানে। সে ওই মেয়েদের মধ্যে থেকে শিকার বেছে নেয়। বিয়েতে রাজি করাতেও নেয় কৌশলের আশ্রয়। বিয়ের কিছুদিন পরই বেরিয়ে পড়ে আসল চেহারা। কোমল জানান- মেয়ে সংক্রান্ত অভিযোগের কারণে সরকারি চাকরিও হারিয়েছে সে। রাজীবের প্রতারণার শিকার মিতু জানায়, ২০১৩ সালের ৩রা জুলাই সে আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। লাইফটা ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ খোঁজে পেলাম না। পড়াশুনা শেষ হয়ে গেলো। আমি তখন আর মেট্রিক পাস করতে পারিনি। এখন উন্মুক্ত থেকে এসএসসি পাস করেছি।
তার জন্যে ফ্যামিলিকে কলঙ্কিত করলাম। এখন নিজে রোজগার করে নিজেকে চালাই। অথচ আমার কাজিনরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করে। লাইফটা আজকে অন্যরকম হবার কথা ছিল আমার। পরিবারের কেউ খোঁজ নেয় না এখন মিতুর। একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করে নিজের জীবন চালিয়ে নিচ্ছে সে। সামর্থ্য বা পরিবারের কেউ পাশে না থাকায় মিতু এই প্রতারকের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যাননি। আল্লাহর কাছে চাইছেন তার বিচার। কোমলের ভাই কেএম হাবিবুল্লাহ বলেন, ও একটা ঠগবাজ ছেলে। তার প্রফেশন জায়গা জায়গায় বিয়ে করা। এসব বিষয়ে মো. রাজিব হাসানের বক্তব্য জানতে চাইলে বলেন-এগুলোর কোনোটারই ভিত্তি নেই। কোর্টে মোকাবিলা করছি। কোর্টের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত হলে আমি এর প্রায়শ্চিত্ত করবো। আর ভদ্রমহিলা যে মামলাটি করেছেন তা মিথ্যা।-এমজমিন
মন্তব্য চালু নেই