হাসপাতালের ‘নতুন আল্ট্রাসনো মেশিনে’ পানি ডুকিয়ে বিকল
সরকারী সম্পদ বিনষ্টকারী কে এই ডা. জহির?
আল আমিন, ঝালকাঠি থেকে : শেষ পর্যন্ত ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে শিল্পমন্ত্রী আলহাজ্ব আমির হোসেন আমুর প্রচেষ্টায় নতুন অত্যাধুনিক আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন উদ্বোধনের একমাসের মধ্যে পানি ডুকিয়ে নষ্ট করার দায়ে ফাঁসলেন ডাক্তার জহিরুল ইসলাম জহির। দীর্ঘ দিন ধরে সদর হাসপাতালে সরকারী চাকুরীর আঁড়ালে মানবসেবাকে জলাঞ্জলী দিয়ে আর্থিক ফয়দা লুটে আসলেও এবার নতুন আল্ট্রাসনো মেশিনে গোপনে পানি ডুকিয়ে নষ্ট করার দায়ে ধরা খেয়ে পড়েছেন মহাগ্যাড়াকলে।
ইতিপূর্বে তার বিরুদ্ধে দূর্নীতি, আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট বাণিজ্য, রাজাপুর-ঝালকাঠিতে ক্লিনিক ব্যবসা ও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা বানিজ্যের অভিযোগ উপেক্ষা করে বহাল তবিয়তে থাকলেও এবার ধরা খেয়ে পিঠ বাচাঁতে হিজলা উপজেলার (ভারপ্রাপ্ত) স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে বদলী হয়েছেন।
অন্যদিকে অর্থলোভী ডাঃ জহিরের এহেন ঘৃন্য অপকর্মের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ‘শূধু বদলীই যথেষ্ট নয় এখানে চাকুরি কালীন তার সকল দূর্নীতি-অপকর্মের’ তদন্ত স্বাপেক্ষে বিচারের দাবী করেছেন বিভিন্ন সংগঠন। সেই সাথে ডাঃ জহিরের ভবিষ্যতে যাতে কোন তদ্ববীরের এ জেলা আসতে না পারে সে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য ঝালকাঠি নাগরিক ফোমার ‘শিল্পমন্ত্রী সহ উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের নিকট’ দাবী জানিয়েছে।
জানা গেছে, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের রোগীদের দূর্ভোগ লাঘবে শিল্পমন্ত্রী আলহাজ্ব আমির হোসেন আমুর প্রচেষ্টায় একটি অত্যাধুনিক নতুন আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন বরাদ্ধ করিয়ে গত ১৩ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে মেশিনটি উদ্বোধন করেন। রহস্য জনক ভাবে মাত্র ২১ দিনের মাথায় মেশিনটি কে অচল ঘোষনা করে সাধারন রুগীদের প্রাইভেট প্যাথলজিতে পাঠানো শুরু হয়। নতুন আল্ট্রাসনো মেশিন ২১ দিনের মাথায় নষ্ট হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা খোজ নিলে ঝালকাঠি সদর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা: জহির বিষয়টি ভিন্নখাতে নিতে ‘মেশিনের ভিতরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রগ্রাম ডাউনলোড দেয়ার সময় ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে’ বলে অপপ্রচার করেন।
এনিয়ে স্থানীয় মিডিয়ায় শোরগোল শুরু হলে সিভিল সার্জন ডা: আব্দুর রহিম সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মেশিনটি সংস্কার ও চালু করে দিতে চিঠি দেন। এঅবস্থায় গত ১৯ এপ্রিল মেশিন সরবারহকারী এমএ কমিউনিকেশন কোম্পানীর প্রকৌশলী (টেকনিক্যাল) দেব দুলাল চন্দ্র ধর ঝালকাঠি আসেন। তিনি পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর মেশিনের কন্ট্রোল বোর্ডে পানি ডুকিয়ে ড্যামেজ করেছে বলে নিশ্চিত হন। কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে কন্ট্রোল বোর্ডের মধ্যে পানি না ডুকালে এখানে পানি যাওয়া অসম্ভব বলে তিনি ব্যবহারকারির কারনেই এ সমস্যা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিকরা কোম্পানীর প্রকৌশলী (টেকনিক্যাল) দেব দুলাল চন্দ্র ধরের কাছে ‘মেশিনটি অচলের কারণ জানতে চাইলে জানায়, নতুন মেশিনে এধরনের ত্রুটি হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। কারণ চালু করার সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাঃ জহিরকে সার্বিক বিষয়ে হাতে কলমে দেখিয়ে চালু করে দেয়া হয়েছিল। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এটি অচল হওয়ার খবরে আমরা বিস্মিত হয়ে ঝালকাঠিতে আসি। এখানে মেশিন চেক করে ইচ্ছাকৃত ভাবে সৃষ্টি করা এ ত্রুটি দেখতে পাই।
তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন এধরনের ত্রুটির জন্য কোম্পানী কোন দায়দায়িত্ব নিবেনা। কারণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সরবরাহের পর ওয়ারেন্টির নিদৃষ্ট সময় পর্যন্ত মেশিনের কোন যন্ত্রাংশ বিকল হলে কোম্পানী তা সরবরাহ করবে। এখানে ব্যবহারকারির কারণেই কন্টোল বোর্ডে পানি ঢুকেছে, যার জন্য কোম্পানী দায়ী নয়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ‘কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে’ ডাঃ জহির এখান থেকে দ্রুত বদলি হয়ে বরিশালের হিজলা উপজেলার (ভারপ্রাপ্ত) স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন।
এরপূর্বেও ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে আরো একটি নতুন আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি দেয়া হয়েছিলো, ডাঃ জহির সেটিরও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো। সে মেশিনটি কিছু দিনের মধ্যেই ইচ্ছাকৃত ভাবে ডাঃ জহির অকেজ করে রোগীদের প্যাথলজিতে প্রেরন করে আসছিলেন। কিন্তু সেবার সাংবাদিকরা তেম অনুসন্ধান না চালানোর কারনে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় সহজেই অপকর্ম করে পার পেয়ে যান।
এরপর রোগীদের দূর্ভোগ লাঘবের বিষয়ে সাংবাদিকদের লেখালেখি ও টিভি প্রতিবেদনের পর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি নতুন মেশিন বরাদ্ধ চেয়ে চিঠি পাঠায় শিল্পমন্ত্রী আলহাজ্ব আমির হোসেন আমু। কিন্তু মন্ত্রী আমুর হস্তক্ষেপে নতুন মেশিন আসলে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে ও প্যাথলজি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আবারো সেটি ইচ্ছাকৃত ভাবে অচল করতে উদ্দোগ নেয় এই ডাঃ জহির।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, পার্শবর্তী জেলা পিরোজপুরের সন্তান ডাঃ জহিরুল ইসলাম জহির এভাবে সাধারন মানুষের রক্ত চুশে পকেট ভাড়ী করার জন্য সরকারী আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি অচল করে রাখতো। সেই সুয়োগে ঝালকাঠি হাসপাতাল থেকে রোগীদের বাহিরে ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে নিজেই অর্থের বিনিময়ে রিপোর্ট লিখেন।
একদিকে ডাঃ জহির পাঠানো রোগীর বিনিময়ে কমিশন অপরদিকে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার থেকে রিপোর্ট লেখার বিনিময়ে বড় অঙ্কের অর্থ পেতেন। মানুষত্ব বিসর্জন দিয়ে এভাবে তিনি প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা অবৈধ ভাবে উপার্জন করতেন। কিন্তু হাসপাতালের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি সচল থাকলে ডাঃ জহির ও স্থানীয় প্যথলজি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটতো। যে কারনে এবারেও তিনি মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এহেন অপতৎপরতা চালান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিকিৎসক জানান, ডাঃ জহির প্রভাব খাটিয়ে নিজে স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক পদের দায়িত্বে নিতেন। আর সেটাকে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করে তিনি হাসপাতালের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেই সারাদিন বাহিরের কিছু ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে গিয়ে চিকিৎসা করে ফায়দা লুটতেন। উর্ধতন কেউ হাসপাতাল পরিদর্শনে এলে ঐ সকল দায়িত্বে বাহিরে আছেন জানিয়ে নির্বিগ্নে পিঠ বাঁচাতেন।
এভাবে তিনি ঝালকাঠি ছাড়াও পাশ্ববর্তী রাজাপুর, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া ও কাউখালীতেও চিকিৎসা বানিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। ঝালকাঠি হাসপাতালের একজন মেডিকেল অফিসার হওয়া সত্বেও নিজেকে মেডিসিন সার্জারি, মা ও শিশু এবং ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ বলে প্রচার করতেন। চিকিৎসা বিধি লংঘন করে সে রাজাপুরের নিউ এ্যাপোলো ও সোহাগ ক্লিনিকের ব্যবস্থাপত্রে নিজেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লিখে প্যাড ছাপিয়েছেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি ঝালকাঠি ও রাজাপুর দুটি প্রাইভেট ক্লিনিকের ব্যবসায়ীক অংশিদারে পরিনত হন।
এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা আল্ট্রাসনো মেশিনে পানির ডুকানোর দায় এ্যাঁড়াতেই কি বদলি হলেন জানতে চাইলে ডাঃ জহিরুল ইসলাম জহির ‘মেশিনে পানি পাওয়া গেছে তা আপনি কিভাবে জানলেন’ বলে পাল্টা প্রশ্ন করেন। সরবরাহকরী কোম্পানীর প্রকৌশলী তার প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বললে ডাঃ জহির বলেন, কই আমার সাথে তো তিনি এরকম কিছু বলেনি। তবে সিভিল সার্জনের কাছে দেয়া রিপোর্টে পানির কথা লেখা হয়েছে জানালে ডাঃ জহির ‘তাহলে আপনারা সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলুন’ বলে চলে যান ।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডাক্তার আঃ রহিম বলেন, প্রকৌশলীর রিপোর্টে মেশিনটি নষ্ট হওয়ার জন্য পানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কবে নাগাদ মেশিনটি চালু করা হবে এ বিষয়ে সিভিল সার্জন জানান, আমি বিষয়টি জানিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। এখন তাদের উপরেই পরবর্তি পদক্ষেপ নির্ভর করছে।
মন্তব্য চালু নেই