পুলিশও ভালোবাসতে জানে
আমাদের চরিত্রের সবচেয়ে বড় দোষ হলো চিলে কান নিয়ে গেছে শুনলেই কান খুঁজতে সারা পৃথিবী দৌড়ে বেড়াই। কিন্তু নিজের কানে আর হাত দিয়ে দেখা হয় না আমাদের। আমরা খারাপ স্মৃতিগুলো এতোবেশি মনের দৃশ্যপটে যত্ন করে রাখি যে, ভালো স্মৃতি এলেও সেখানে আর স্থান করে নিতে পারে না। ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ শুনলেই ৯০ শতাংশ মানুষের মুখে বদনাম ছাড়া সুনামের গল্প আপনি শুনবেন না। অথচ এই ৯০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে পুলিশের সহযোগিতা পেয়েছে যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
একটা জাতিকে কয়েকটি মানুষ দিয়ে যাচাই করা যায় না। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান হয় না তেমনি প্রত্যেকটি গোষ্ঠী, জাতি, ধর্মের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের মানুষ রয়েছে। পৃথিবীর সব ইমাম, পুরোহিত, ভান্তে, ফাদারকে আপনি এক দাড়িপাল্লায় ভালো বলে সনদ দিতে পারবেন না। এদের মধ্যেও রয়েছে ভালো খারাপ। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদান করে এমন একটি বাহিনীর নাম পুলিশ। একটা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য যেসব পরীক্ষা নেয়া হয়, তাতে একটি মানুষের ব্যক্তিগত চরিত্রের সবটা ফুটে ওঠে না। তাই প্রত্যেকটি পুলিশের আচরণেও মানুষ হিসেবে ভিন্ন রুপ দেখা যায়। পুলিশ তো মানুষই।
গত কিছুদিন আগে এক পুলিশ কনস্টেবল একটি শিশুকে নির্যাতন করে, যা বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি ঘৃণীত কাজ। পুলিশ বলে তার শাস্তি কিছুটা কম হবে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এই পুলিশের মধ্যেই অনেকে রয়েছেন যারা দিনরাত দায়িত্ব পালন করেও সাধারণ মানুষকে একটু বেশি দেয়ার চেষ্টা করছেন। মোটেও এই দায়িত্বগুলো তার পোশাকের দায়িত্ব নয়। কিন্তু তার পরও মানুষ হিসেবে সেই পুলিশরা নিরব থাকতে পারেননি। মানবীয় দায়িত্ববোধ থেকে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্বে ছিল এই পুলিশ নামের আতঙ্করাই। চলুন, এক পুলিশ সার্জেন্টের জীবনের গল্প বলি আপনাকে। নিশ্চিত থাকুন, এ কোনো রুপকথা নয়! আলাদিনের গল্পও নয় অথবা ডেনমার্কের কোনো পুলিশ কর্মকর্তার জীবন কাহিনীও নয়। খুবই সাধারণ এই দেশের এক কামরুল হাসানের কথা। পুলিশ পোশাকে তার দায়িত্ব সার্জেন্টের।
দেশের রাস্তাঘাট খুব খারাপ না হলেও ছোটখাট গর্ত রাস্তার জন্য খুব সাধারণ ব্যাপার। রাস্তায় গর্ত হয়েছে। পানি জমে রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়েছে। তা নিয়ে পুলিশের মাথা ব্যথা থাকবে কেন? পুলিশের কাজ রাস্তায় কোনো আইন অমান্য করা হলে পকেট থেকে জরিমানার মেশিন বের করে একটি প্রিন্টেড কেস স্লিপ উপহার দেয়া। সেই পুলিশ যদি রাস্তায় চলাচলে গাড়িগুলোর অসুবিধা দেখে নিজেই রাস্তা সাময়িক মেরামতের জন্য ইট এবং ইটের টুকরো এনে রাস্তাকে সহজ করে তাহলে আপনার মনে হবে, এ আমাদের দেশে অসম্ভব। কিন্তু না, আমি কামরুল হাসানের কথাই বলছি।
জেএমবি অপারেশন ও অস্ত্র উদ্ধার করে সাহসিকতার জন্য পেয়েছেন পিপিএম পদক। তাই বলে রাস্তার পাশের শিশুটিকে হাতে তুলে খাইয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেননি। নিজের বেতন খুব বেশি না হলেও দিনমজুর ভাইটিকে নতুন পোশাক কিনে দিয়ে তিনি পান অপার আনন্দ। রাস্তায় ভিক্ষা করা গরীব মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে একটি রুটি কিনে দিতে কোটিপতি হতে হয় না। কিন্তু ক’জন কোটিপতিকে আপনি এ কাজ করতে দেখবেন? কামরুল হাসান অবলীলায় এই কাজ করেছেন। লোক দেখাতে নয়, মনের তৃপ্তি আর মানুষ হিসেবে দায়িত্ববোধের জন্য।
শীতার্ত রিকশাওয়ালা শীতের তীব্রতায় রাতে ঘুমোতে পারেন না। আমি আর আপনি তো কত্ত আরামে চার দেয়ালে শীতদের সাথে আড়ি দিয়ে কম্বলের সাথে বন্ধুত্ব করি। কয়জন মানুষকে কম্বল কিনে দিয়েছি আমরা? অথচ কামরুল হাসানের বাসায় বিদেশি কম্বল না থাকলেও সাধারণ মানুষের হাসি কিনতে বিলাসিতার চেয়ে ভালোবাসাকেই প্রাধাণ্য দিয়েছেন। এ যে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা।
রাস্তার পাশের কাগজ টোকানো ছেলেটাকে পড়াশোনা শেখানো চারটিখানি কথা নয়। অথচ ওই শিশুরাও সঠিক দিক নির্দেশনা পেলে একসময় হতে পারে জাতীর গর্ব। সাকিব নামে এক শিশুকে পাঁচ মিনিটেই শিখিয়ে দিলেন নিজের নাম বাংলায় এবং ইংরেজিতে লিখতে। পড়াশোনা করার লোভ দিলেন প্রতিদিন ৩০ টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। পড়াশোনার ফাঁকে কাজের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন।
এমন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবলের গল্প যদি আমরা শুনি, তাহলে হয়তো আমাদের শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাবে। এমনটা ভেবেও বসতে পারেন- ওরা যদি এতো ভালো হয়, তাহলে এতো খারাপ সংবাদ কি সব বানোয়াট? এ কথা আমি মোটেও বলছি না। পুলিশ ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো প্রাণী নয়। আমাদেরই কারও সন্তান, কারও পিতা, কারও ভাই বা কারও আত্মীয়। আমাদের চারপাশে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যেমন ভালো-খারাপ আছে তাদের মধ্যেও তেমনি।
তাহলে সব জায়গাতে পুলিশ কেন দোষী? যার কাজ বেশি, তার বদনামও বেশি। আজ থেকে যদি আপনাকে দেশের সব আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আপনার ভালো গুণ মানুষ প্রকাশ না করলেও খারাপ দিকটা বেশ ফলাও করেই প্রচার হবে। এ পেশাটাই এমন। মানুষের সাথে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ এ পেশাতেই বেশি। তাই একটু স্লিপ খেলেই সরাসরি বঙ্গোপসাগর। আসুন, আমরা অন্তত দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই। পুলিশের ভালো গুণগুলো বেশি বেশি আলোচনা করি। আমাদের আলোচনায় হয়তো তাদের ভালো কাজের আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে। আর খারাপ লোকের পুলিশগুলো নিজেদের আচরণ বদলে নিতে সচেষ্ট হবে।
এমন বাংলাদেশই তো চাই আমরা! ভালো কাজের প্রচার হোক আমাদের লক্ষ্য। কামরুল হাসান বলেন, ‘যতো পারেন ঘৃণা করুন। আমার কাজ আমি করে যাবোই।’
মন্তব্য চালু নেই