ভূমিকম্প নিয়ে যত ভুল ধারণা

১. পড়িমরি করে দৌড় দিতে হবে : সম্পূর্ণ ভুল। কারণ একাধিক। বেশিরভাগ ভূমিকম্প ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। হাইরাইজ অধিকাংশ এপার্টমেন্ট থেকে এটুকু সময়ে নিচে নেমে আসা অসম্ভব, ভূমিকম্প না থাকলেও। বিশ্বাস না হলে এখনই একটা দৌড় দিয়ে দেখতে পারেন।

তাছাড়া, একটা সাধারণ যোগ অংক করুন। ভূমিকম্প হলো। আপনি টের পেলেন এবং বোঝার চেষ্টা করলেন কি হচ্ছে, এতে গেল ৫ সেকেন্ড। ভূমিকম্প বোঝার পরপর পরিবারের সবাইকে আতঙ্কিত হয়ে জানাতে গেলেন এবং দৌড়াতে বললেন, গেল কমপক্ষে আরও ১০ সেকেন্ড। এই ১৫ সেকেন্ডেই অধিকাংশ ভূমিকম্প শেষ। লিফট ব্যবহারের বোকামি যেহেতু করবেন না, তাই নিশ্চয়ই সিঁড়ি দিয়ে নামবেন। একতলা নামতে নামতেই আরও ১০ সেকেন্ড চলে গেছে। যোগফল ৫ +১০ + ১০ = ২৫ সেকেন্ড এবং এটা শুধু এক তলা নামার হিসাব। এরকম প্রতি তলায় ১০ সেকেন্ড করে যোগ হবে। কি করে নামবেন ভূমিকম্পের আগে?

পরিসংখ্যানগত কারণেও দৌড় দেয়া উচিত নয়। ধরুন, আপনি বিল্ডিং এর একটা রুমে আছেন। এই রুমের ছাদ ভেঙে পড়তেও পারে, নাও পড়তে পারে। আশঙ্কা ৫০/৫০। কিন্তু, যদি আপনি দৌড় দেন, হয়তো আপনাকে ভবনের এমন আরও ৫টা জায়গার ছাদ পারি দিয়ে তারপর নিচে নামতে হবে। মানে আপনাকে ১ বারের পরিবর্তে ৫ বার নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে হবে। নিজের ভাগ্যের ওপর এত ভরসা থাকলে দৌড় দিলেও দিতে পারেন, আপনার ইচ্ছা।

বাংলাদেশের মতো দেশে দৌড় না দেয়ার আরেকটি কারণ, সিঁড়িতে গিয়ে দেখবেন আপনি একা না। আপনার মতো ভবনের আরও বাসিন্দা যারা জানেন যে দৌড় দিতে হয়না, তারাও পড়িমরি করে ছুটছেন। ভূমিকম্পে আহত হন আর না হন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পায়ের নিচে পড়ে আহত হওয়ার আশংকা তার চেয়ে বহুগুণে বেশি। এ দেশে হওয়া সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোর ইতিহাসও তাই বলে। প্রায় সবাই আহত হয়েছে না বুঝে দৌড় দিয়ে পালাতে গিয়ে। তবে একদম ভবনের নিচতলায় দরজার কাছে কেউ থাকলে দৌড়ে বাইরে বেরোতে পারেন। এটায় মনে হয় সমস্যা নাই।

আপনার প্রশ্ন এখন, দৌড় না দিয়ে কি করবো? নিয়ম অনুযায়ী আপনি টেবিল, ডেস্ক, চেয়ার, শোয়ার খাট – এই ধরনের কোনো আসবাবপত্রের নিচে ঢুকে যাবেন এবং মাথায় হাত দিয়ে রাখবেন, যাতে ওপর বা আশপাশ থেকে পড়া কিছু আপনার মাথায় সরাসরি না পরে। এই ভিডিওগুলো ফলো করতে পারেন। প্রথমটি জাপানের, যে দেশ ভূমিকম্প ফেস করে আপনার-আমার চেয়ে বহু গুণ বেশি অভিজ্ঞ। পরেরটি যুক্তরাষ্ট্রের। যতই হাস্যকর দেখাক, এটাই সঠিক কাজ।

# https://youtu.be/KiB7ny52-xw

আপনার প্রশ্ন, ভবন ধসে পড়ে গেলে? তাহলেতো এমনিতেও বাঁচবো না। আসবাবের নিচে লুকিয়ে কি লাভ? ভবন ধসের পর যারা ধ্বংসস্তূপে বাঁচেন, তাদের বেশিরভাগই কোনো একটা ফাঁকে আটকা পড়েন। উদ্ধারকারীরা এগুলোকে বলেন ‘পকেট’। পকেট সৃষ্টি হয়, যদি ভেঙে পড়তে থাকা পিলার বা ছাদ কিছুতে বাধা পায়। যে আসবাবের নিচে ঠাঁই নিয়েছিলেন, তা শুধু আপনার মাথাকে সরাসরি আঘাত থেকেই রক্ষা করবে না, ধ্বংসস্তূপে পকেট সৃষ্টিতেও কাজে লাগতে পারে। কোথাও আশ্রয় নিলে আপনি প্রস্তুত থাকতে পারবেন। ছাদ পড়ে যাওয়ার আগে মুহূর্ত পর্যন্ত সজাগ থাকতে পারবেন। দৌড়ালে, আপনি পালানো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকবেন। আশেপাশে কি হচ্ছে তা বোঝার সুযোগই পাবেন না। আর ভবনই যদি ধসে যায়, তাহলে সিঁড়ি কেন বাদ থাকবে – সেটাও মাথায় রাখুন। তাই, প্লিজ, দৌড় দেবেন না।
এতকিছুর পরও যদি আপনার মন না মানে এবং দৌড়াতে ইচ্ছে করে, তাইলে সিরিয়াসলি… দৌড় দেন। খালি বাকিদের এই পরামর্শ দিয়েন না।

২. আবার ১ ঘণ্টা পর/অমুক সময় ভূমিকম্প হবে : এটা আংশিক ভুল। ভুল এই অর্থে যে, কতক্ষণ পর আবার ভূমিকম্প হবে তা কেউ জানে না (সেটা বলা গেলেতো এর আগেরটা হওয়ার আগেই বলা যেত)। তবে খুব জোরালো ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আফটারশক হয়। আফটারশক মূল ভূমিকম্পের চেয়ে মাত্রায় কম হয়। আরেকটা বিষয় হলো, কোনো জায়গায় খুব অল্প কদিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প, ওই স্থানের ভূতাত্ত্বিক অস্থিরতা বোঝায়। বড় ভূমিকম্পের আভাস এভাবে পাওয়া যায় কখনো কখনো। কিন্তু, ভূমিকম্প কোনো নিশ্চিত বিষয় নয়। সময় বা তারিখ দেখে আসে না। তাই, যেসব অগা-মগা অনলাইন বলছে, ‘৪৮ ঘণ্টা পর আবার ভূমিকম্প’ – এগুলোর পশ্চাতে লাথি মারুন।

৩. গরমে/আবহাওয়ার পরিবর্তনে/সূর্যগ্রহণে ভূমিকম্প হয় : ভুল। ভূমিকম্প হয় পৃথিবীর ভূত্বকের বড় বড় খণ্ড যা টেকটোনিক প্লেট নাম পরিচিত – সেগুলোর চলাচল ও সংঘর্ষের কারণে। টেকটোনিক প্লেট চলাচল করে তার নিচের লাভাসহ বিভিন্ন আগ্নেয় তরলের কারণে। বাংলাদেশ ৩টি টেকটোনিক প্লেটের সন্ধিস্থলে অবস্থিত: ইন্ডিয়ান, ইউরেসিয়ান এবং বার্মা প্লেট।

দেখতে পারেন ভিডিও: https://youtu.be/PwtFuG_M4EE

ভূমিকম্প আর বজ্রপাত, খুব কম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি, যেটির সময় আর স্থান আগে থেকে নিশ্চত করে বলা যায়না, বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরেও।

একটা কথা – গুজব ছড়াবেন না। নিজের বাঁচার ইচ্ছে নাই থাকতে পারে, বাকিদের সুযোগটা নষ্ট করবেন না। এত সিম্পল একটা বিষয় নিয়ে এত বড় লেখা দিতে হচ্ছে, সেটাও কম দুঃখজনক নয়। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে এগুলো নিয়ে এখনো তেমন কোনো জনসচেতনতা গড়ে ওঠেনি।

লেখক : নাফিস ইফতেখার



মন্তব্য চালু নেই