এটি সিনেমা বা নাটকের দৃশ্য নয়, শিকল দিয়ে বেঁধে এক তরুণীকে ১০ঘন্টা নির্যাতন !
জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্ব অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করলেও এখনো কিছু কিছু নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা মানব সমাজকে পীড়া দেয়। এর একটি হচ্ছে নারী নির্যাতন। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং সমাজের উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তারপরও সাধারণভাবে তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকারের দিক দিয়ে এখনো পুরুষের সমকক্ষ নয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের দরিদ্র জনগণের ৭০ শতাংশই নারী এবং মাত্র এক শতাংশ নারীর নিজস্ব মালিকানায় সম্পত্তি আছে। এ প্রতিবেদনটিই প্রমাণ করে যে, নারীরা কোনভাবেই পুরুষের সমানাধিকার পাচ্ছে না। এছাড়া দুঃখজনকভাবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে।
নারী নির্যাতনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রূপ হচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতন। পাশাপাশি তারা এখন ন্যাংকারজনক ভাবে ধর্ষণেরও শিকার হচ্ছে। প্রতি তিন জন নারী’র একজন তার স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়। যে নারী ও পুরুষ জীবনে সুখী হওয়ার জন্য সংসার জীবন গড়ে তুলেছেন, তাদের কাছে এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত দুঃখজনক। পবিত্র কোরানের সুরা রূমের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “মহান আল্লাহ তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জন্য সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা পরস্পরের কাছে সুখ ও আল্লাহ’র রহমত লাভ করতে পারো। যারা চিন্তাশীল তাদের জন্য এতে আল্লাহর মহিমার নিদর্শন রয়েছে।” কিন্তু যে সব পুরুষ তাদের ঘরকে নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত করেন, যারা শুধু স্ত্রী নয় সেই সাথে সন্তানদেরকে শারিরীক ও মানসিকভাবে কষ্ট দেন, তারা আল্লাহ’র দৃষ্টিতে অত্যাচারী।
নারী নির্যাতনের যে ভয়াবহ রূপটি ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের ওপর মারাত্মক ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে সেটি হচ্ছে শ্লীলতাহানী। দুঃখজনকভাবে গত কয়েক দশকে এই বিষয়টি পশ্চিমা দেশগুলোতে ভয়াবহ রকমভাবে বেড়ে গেছে। পাশ্চাত্যে প্রতি ৫ জন নারী’র একজন জীবনের কোন না কোন সময়ে ধর্ষণ বা ধর্ষণের হুমকির শিকার হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে এক লাখ ৩২ হাজার বলাৎকারের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে যারা ধর্ষণের খবর প্রকাশ করেন না, তা হিসেব করলে এর পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এদিকে ধর্ষণের যে মারাত্মক ক্ষতিকর দিকটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায়, তা হচ্ছে কথিত সম্মান রক্ষার জন্য নারী হত্যা। কখনো কখনো ধর্ষিত নারী’র বাবা, ভাই, স্বামী বা অন্যান্য নিকটাত্মীয় পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য ধর্ষিতাকে হত্যা করে। এক্ষেত্রে নারী দুই বার নির্যাতনের শিকার হয়। একবার অপরিচিতজনের কাছে নিজের সম্ভ্রম হারায়। এরপর পরিচিত জনদের হাতে জীবন বিসর্জন দেয়। জাতিসংঘের এক হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর এ ধরনের কথিত সম্মান রক্ষার বলির শিকার হয় প্রায় ৫ হাজার নারী।
দেহ ব্যবসায় নারীকে বাধ্য করা হচ্ছে নারী নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ রূপ যা কমবেশী সব দেশেই দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে একশ্রেনীর মানুষরূপী পশু মেয়েদেরকে এ কাজে বাধ্য করে। এছাড়া অবৈধ সম্পর্কের পরিণতিতেও অনেক সময় মেয়েরা দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সুসংগঠিতভাবে একটি গোষ্ঠি নারীদের দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য করে। দুঃখজনকভাবে ধর্ষণের মত অমানবিক ও অনৈতিক কাজ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকায় পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা অধিক হারে লক্ষ্য করা যায়। পাচার হয়ে যাওয়া নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাসের মত কেনাবেচা করা হয় এবং কিছু লম্পট পুরুষ এসব অসহায় নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন চালায়। দুঃখজনকভাবে নারী ও শিশু পাচার বর্তমানে ব্যাপক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ ব্যবসার ফলে একদিকে পাচারকারী দালালরা মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, আর অন্যদিকে হাজার হাজার নারী ও শিশুর জীবনে নেমে আসছে চরম দুর্ভোগ ও দুর্বিসহ জীবন।
নারী নির্যাতনের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তার লিঙ্গ নির্ধারণ। দুঃখজনকভাবে এই একবিংশ শতাব্দিতে এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যারা গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হলে তাকে মায়ের পেটের মধ্যেই মেরে ফেলতেও কুণ্ঠিত হয় না। একে জন্মের আগেই হত্যা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কখনো কখনো জন্মের আগে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা না গেলে জন্মের সাথে সাথে শিশুকন্যাকে হত্যা করা হয়। সাম্প্রতিক কালে ভারতে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়, যার কারণে ভারতের কোন কোন রাজ্যে নারী ও পুরুষের আনুপাতিক হারে সামঞ্জস্যহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এছাড়া যৌতুক বা পনপ্রথার কারণেও ভারতে ব্যাপক হারে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। দেশটিতে প্রতি বছর ১২ হাজারেরও বেশী মেয়েকে পণ দিতে না পারার কারণে হত্যা করা হয়।
যুদ্ধের কারণেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নারী হতাহত হচ্ছে। ইহুদীবাদী ইসরাইলী সেনারা ফিলিস্তিনী এলাকাগুলোতে যে ভয়াবহ গণহত্যা চালাচ্ছে, তার ফলে হতাহতদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে নারী। কোন কোন যুদ্ধে নারীদের ওপর ব্যাপক হারে যৌন নির্যাতন চালানো হয়। এখানে উদাহরণ হিসেবে বলকান যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐ যুদ্ধে বসনিয়ার বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে বর্বর সার্ব সেনারা বসনিয়ার নারীদের ওপর গণধর্ষণ চালিয়েছিল।
নারী নির্যাতনের এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বিশ্বের বিশেষ কোন একটি দেশে নারীদের ওপর যেমন নির্যাতন চালানো হয় না, তেমনি এ নির্যাতনের ধরণও এক এক যায়গায় এক এক রকম। যেমন নারীদের সম্ভ্রমহানী ও তাদের যৌন ব্যবসায় বাধ্য করার ঘটনা পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশী দেখা যায়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অন্যায় সামাজিক প্রথার কারণে নারীরা বেশী নির্যাতনের শিকার হয়। এছাড়া নারীরা অনেক সময় সহিংস হামলার শিকার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অনুমতি থাকায় নারীদেরকে যত্রতত্র হত্যা করা হচ্ছে। রাশিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে অতিরিক্ত মাত্রায় মদ পান করার কারণে মাতাল স্বামীরা স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের অধিকার সচেতনতার অভাব, স্ত্রী ও পরিবারের প্রতি পুরুষদের দায়িত্বজ্ঞানহীতা এবং নারীদের নীরবে নির্যাতন সহ্য করার প্রবণতা তাদের ওপর নির্যাতনের প্রধান তিনটি কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী শিক্ষা এবং তাদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে নারী নির্যাতন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে সবার আগে সমাজের প্রচলিত ভুল রীতিনীতিগুলো পরিবর্তন করতে হবে এবং নারীদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে এবং সংসারে নারীকে সম অংশিদারিত্বের মর্যাদা দিতে হবে। ইসলামও নারীকে পুরুষের মত সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেছে এবং তাদের প্রতি বৈষম্য করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। অবশ্য নারীদেরকেও সমাজে এমনভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে হবে যাতে তাদের সম্মান, মর্যাদা ও সতীত্ব বজায় থাকে। উপযুক্ত পোশাক বা হিজাব পরিধানের মাধ্যমে নারী সমাজ নিজেদেরকে লোলুপ পুরুষদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার প্রেম ও ভালোবাসার স্থান এবং এখানে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থাকতে হবে। কারণ, নারী নির্যাতন কঠিন অপরাধের কাজ এবং এ কাজে মহান আল্লাহ মারাত্মকভাবে অসন্তুষ্ট হন।
ছবি পরিচিতিঃ বরিশালের একটি গ্রামের ঘটনা। মেয়েটির নাম রুপা আক্তার। ১০ ঘন্টা বেধে রেখে তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ফেসবুক থেকে সংগৃহিত
মন্তব্য চালু নেই