শিশুর হাতে প্রযুক্তি তুলে দেওয়ার আগে ভাবুন
এমন একটা সময় ছিল যখন আমরা ঘুম থেকে উঠেই কোন আলোকিত স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দিন শুরু করতাম না। কম্পিউটারের মূল কাজ ছিল টাইপ করা, হিসেব রাখা। প্রযুক্তি তখনো গ্রাস করে নি আমাদের খেলার মাঠ, স্কুল বা ছুটির দিনগুলোকে।
কিন্তু এখন? শিশুরা সারাক্ষণই আছে স্ক্রিনের সামনে। বাবা মায়ের মোবাইল নিয়ে বসে পড়ছে যে কোন সুযোগে। নতুবা কম্পিউটারে, ট্যাবলেটে, আই প্যাডে। অনেক বাবা মা ১০/১২ বছরের বাচ্চার হাতেও তুলে দেন ট্যাবলেট।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এতে কি আগের চেয়ে বুদ্ধিমান হচ্ছে আমাদের শিশুরা? তাদের মানসিক বিকাশ কি আরও ভাল হচ্ছে? সৃজনশীলতা বাড়ছে? যদি তা না হয় তাহলে কেন করছি আমরা এই ভুলগুলো?
ভেবে দেখুন
ইতিহাসে এমন কিন্তু আগে কখনো ঘটে নি। শিশুরা আগে কখনো একসাথে এত তথ্যের মুখোমুখি হয় নি। এখন ইন্টারনেটে প্রবেশের সাথে সাথেই তাদের সামনে খুলে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। মাত্র ১টা ক্লিকেই যে কোন দিকে ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াতে পারে সে। এতে কী হচ্ছে? এত তথ্য থেকে সে তাঁর পছন্দসই তথ্যটিই বেছে নিবে।
চাইলেও শিশুদের এই তথ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ফলে এখন প্রতি পরিবারেই দেখা যায় শিশুদের সাথে বাবা মা এর মনোমালিন্য। আপনি হয়ত সারাক্ষণ খোঁজ নিচ্ছেন সে কী দেখছে! কিন্তু আপনাকে লুকিয়ে দেখা কিন্তু অসম্ভব নয়। এই ভাবনা আপনাকে সন্দেহ প্রবণ করে তুলতে পারে, যা আবার শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে যেটা হচ্ছে, আপনার এবং আপনার সন্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।
প্রযুক্তি এবং অবক্ষয়
আগে একটি শিশু কী করে সময় কাটাতো? সে হয়ত খেলত বন্ধুদের সাথে। ছবি আঁকত, গান শিখতে যেত। ক্লাসের পর জেদ করত মাঠে বন্ধুদের সাথে আরও সময় কাটানোর জন্য। তাদের কারও পয়সা জমানোর সখ থাকত, কেউ ডাক টিকিট জমাতো। শুনে মনে হচ্ছে যেন কোন আদি যুগের গল্প। কিন্তু কয় দিন আগেরই বা কথা এসব?
এখনকার শিশুরা শব্দার্থ বের করে নেট ব্রাউজ করে। শব্দকোষের ব্যবহার তারা জানে না। খুবই সাধারণ বিষয় লাগছে হয়ত এটা। কিন্তু এভাবেই ব্যাহত হচ্ছে আপনার শিশুর মেধার চর্চা। মাথা খাটিয়ে, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ থেকে সরে যাচ্ছে সে। সব কিছুর সমাধান তৈরি পাচ্ছে, ফলে তাকে কিছুই করতে হচ্ছে না। সব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা সত্যি না হতে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা আমাদের মস্তিষ্ককে অকার্যকর করে দেয় দিনে দিনে।
প্রযুক্তির নেশা
দিনে দিনে ঘটনা এতই ভয়াবহ হচ্ছে যে, একে বলা হচ্ছে “প্রযুক্তি অ্যাডিকশন”। দেখা যাচ্ছে, শাসন না করে একটি শিশুর হাত থেকে মোবাইল নেওয়া যাচ্ছেনা, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে মোবাইলে টাকা ঢোকায় যাতে ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন না হয়। এসবই আসক্তির লক্ষণ।
আসক্ত শিশুরা আরও যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়-
১। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
২। সামাজিকতার অদক্ষ চর্চা
৩। মেজাজ খারাপ থাকা
৪। ঘুমের সমস্যা
৫। আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব
তিনটি বড় ভুল যা বাবা মায়েরা করেন
১। প্রযুক্তির উপর কোন নিয়ন্ত্রণ না করা
২। প্রযুক্তির ব্যবহার হয় না এমন কোন পারিবারিক বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকা
৩। বাবা মা নিজেরাই ইন্টারনেট আসক্ত।
বাবা মায়েরা যা করতে পারেন
শিশুকে ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বাঁচাতে বাবা-মায়েরা মৌলিক কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন। এটা খুবই জরুরী। মনে রাখবেন, আপনার শিশু যত বেশী আসক্ত হয়ে পড়বে তত তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
প্রযুক্তি ব্লাঙ্ক আউট
ঘরে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ রাখুন। পরিবারের প্রত্যেকে ওই সময় কম্পিউটার, মোবাইল বা অন্য যে কোন ইলেক্ট্রনিক পণ্য ব্যবহার থেকে দূরে থাকুন। এসময়টা বরাদ্দ করুন বই পড়া, রান্না করা, ছবি আঁকা বা এমন কোন কাজের জন্য।
সময়
একটা সময় বেঁধে প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাস করুন। নিজে মেনে চলুন, সন্তানদেরও উৎসাহিত করুন। একটা গাইড লাইন তৈরি করুন, কতক্ষণ পড়াশোনা, কতক্ষণ গেমস খেলা, কতক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, সব কিছুর। দেখবেন অকারণে ইন্টারনেটে বসে থাকা কমে আসবে।
টেক স্পেস
সম্ভব হলে, আলাদা একটা জায়গা তৈরি করুন যেখানে আপনার কম্পিউটার থাকবে। সেটা কারও বেডরুম নয়। যেখানে কম্পিউটার থাকলে আপনি এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। খেয়াল করে দেখুন, ড্রয়িং রুমে টেলিভিশন থাকলে বেডরুমে থাকলে যত সময় টেলিভিশন দেখতেন তাঁর চেয়ে অনেক কম দেখা হয়। এই বুদ্ধিটিই কাজে লাগান।
আগে থেকে ব্যবস্থা নিন
সবচেয়ে ভাল হয়, আগে থেকে সচেতন হন। আপনার সন্তানের দায়িত্ব আপনার। তাকে যাবতীয় ভাল কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আপনার। প্রয়োজনে নিজের আসক্তি ত্যাগ করুন। আর খেয়াল করুন, কোন বয়সে কতটা তথ্য তুলে দেবেন শিশুর হাতে।
মন্তব্য চালু নেই