বাংলাদেশি ‘সুপারম্যান’
কাছের মানুষদের কাছে পরিচিত বাপ্পী নামে, পুরো নাম ওয়াহিদ ইবনে রেজা। ২৮ মার্চ প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে এই তরুণ বলছিলেন ছেলেবেলার কথা। মা সুরাইয়া করিম তাঁকে একটা পোশাক বানিয়ে দিয়েছিলেন। পোশাকটা ছিল ব্যাটম্যানের। প্রিয় কমিক চরিত্রের পোশাক পরে ছয় বছর বয়সী ওয়াহিদ বাড়িময় ঘুরে বেড়াতেন ছোট ছোট পা ফেলে। ওয়াহিদ বড় হয়েছেন, বড় বড় পা ফেলে পাড়ি জমিয়েছেন কানাডায়।
ব্যাটম্যানের পিঠে যে ঝালরমতো পোশাকটা থাকে, ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় ‘কেপ’, কদিন আগে সেটাই পরেছিলেন ওয়াহিদ। এটা তো অনেকেই পরতে পারেন। ওয়াহিদের বেলায় বিষয়টা কেন গুরুত্ব পাচ্ছে? কারণ, সেটা পরে ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস সিনেমায় অভিনয় করেছেন স্বয়ং বেন অ্যাফ্লেক! খবর এটা নয়। খবর হলো গত ১৯ মার্চ মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার ক্যামেরার পেছনের কুশীলবদের একজন ছিলেন বাংলাদেশের তরুণ ওয়াহিদ!
সিনেমায় আপনার ভূমিকা কী ছিল? ওয়াহিদের মুখে সতেজ হাসি, ‘আমি ছিলাম প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর। কাজটা করেছি অস্কারজয়ী প্রতিষ্ঠান মুভিং পিকচার কোম্পানির (এমপিসি) হয়ে। আমরা মূলত সিনেমার প্রথম ও একদম শেষের অংশের কাজগুলো করেছি। প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়েছে আমাকে। এর মধ্যে কোন শটটা আগে করব, কোনটা পরে—তার সময়সূচি তৈরি করা। সময়সূচি অনুযায়ী সব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করা। রেন্ডার ফার্মগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের কাজটাও করতে হয়েছে। এ ছাড়া মিটিং সেট করা, এটা হারিয়ে গেছে, ওটা হারিয়ে গেছে—সেসব সামলানোর কাজ তো ছিলই।’
নিঃসন্দেহে বিশাল দায়িত্ব। তবে ওয়াহিদ এই ‘লাইনে’ নতুন নন। এর আগে করেছেন এইচবিও চ্যানেলের টিভি ধারাবাহিক গেম অব থ্রোনস এবং নাইট অ্যাট দ্য মিউজিয়াম: সিক্রেট অব দ্য টুম্ব, ফিউরিয়াস সেভেন, ফিফটি শেডস অব গ্রের মতো সিনেমার ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট দলে।
হলিউডের এই কঠিন পথে কী করে পা রাখলেন ওয়াহিদ? এই প্রশ্নের আগে একটা কথা। লেখাটা শুরু হতে পারত অন্যভাবেও! ওয়াহিদের ছবিটা দেখিয়ে নিশ্চয়ই পাঠকের কাছে প্রশ্ন রাখা যেত, ‘ছবির এই তরুণকে চেনা চেনা লাগছে কি না?’ অনেকেই হয়তো হাত তুলতেন, আর বলতেন, ‘আরে, এ তো হিমু!’ কিংবা কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে বলতেন, ‘সেই যে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে কাঁটা চামচ খাওয়া চরিত্রটা না?’ হ্যাঁ, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’ চরিত্রের পোশাকে ওয়াহিদকে দেখা গিয়েছিল একুশে বইমেলায়। সেটা ২০০৭ সালের কথা, হিমুভক্ত ওয়াহিদ তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের চন্দ্রকারিগর নাটকসহ আরও কয়েকটিতে। আর তাঁর কথায়, ‘বিজ্ঞাপনে কাঁটা চামচ খেয়ে তো শিশু দর্শকদের চামচ খাওয়া শিখিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়!’
২০০৬ সালে বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করেন ওয়াহিদ। তারপর যোগ দেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। ওয়াহিদের ভাষায়, ‘আমি খানিকটা অলস টাইপের মানুষ!’ তাই নয়টা-পাঁচটা চাকরিকে টা টা বাই বাই বলে ঘরে বসে লিখতে শুরু করেন নাটক। পরে নাটক নিয়ে অনেক ‘নাটক’ দেখে আবার বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায়। ক্যারটকমে কিছুদিন কাজ করে যোগ দেন গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশে। সেখানে পালন করেছেন কপি হেডের দায়িত্ব।
ওয়াহিদের আরও একটা বড় পরিচয় পাবেন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট-লেখক আহসান হাবীব সম্পাদিত উন্মাদ-এ চোখ বোলালে। প্রিন্টার্স লাইনে ওয়াহিদের নামের পাশে লেখা থাকে ‘বিদেশ প্রতিনিধি’। ২০১০ সালে দেশ ছেড়ে কানাডায় পড়তে যান ওয়াহিদ। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়, ফিল্ম প্রোডাকশন বিষয়ে পড়ার জন্য। দেশে থাকার সময় ছাত্রাবস্থায় যোগ দিয়েছিলেন উন্মাদ-এ, স্টাফ রাইটার হিসেবে। দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত উন্মাদ-এ তাঁর পরিচয় ছিল অ্যাসোসিয়েট এডিটর। ওয়াহিদের ভাষায়, ‘ওয়ান্স এ উন্মাদ অলওয়েজ উন্মাদ!’ ফলে বিদেশ-বিভূঁইয়ে থাকলেও ওয়াহিদের ‘উন্মাদনা’ এখনো অটুট।
হলিউডে তাঁর পা রাখার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। ওয়াহিদ বললেন, ‘ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে ইন্টার্নশিপের জন্য যাই মার্কিন প্রতিষ্ঠান এনবিসি ইউনিভার্সেলে। সেখানে আমার প্রথম কাজ ছিল টেলিভিশন ধারাবাহিক স্যুটস ও ডিফায়েন্স-এ। সেখানে টিভি শো করার দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এরপর ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্ট হিসেবে নির্মাণ করি একটা শর্ট ফিল্ম।’ হোয়াট আই অ্যাম ডুয়িং হেয়ার নামের ওই শর্ট ফিল্মের জন্য পারসিসটেন্স অব ভিশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ওয়াহিদের হাতে উঠেছিল বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের শর্ট লিস্টেও ছিল শর্টফিল্মটির নাম।
ওয়াহিদ বলছিলেন, ‘গ্র্যাজুয়েশন শেষে যোগ দিই অ্যানিমেশন স্টুডিও বার্ডেলে। সেখানে কিছু কাজ করার পর চোখে পড়ল এমপিসির একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। ব্যস, পরীক্ষা দিলাম, উতরেও গেলাম। যোগ দিলাম প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে।’
কদিন আগে কানাডা থেকে দেশে এসেছেন ওয়াহিদ। দেশে আসার আগে এমপিসি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন মেথড স্টুডিওস নামের আরেক বিখ্যাত ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট কোম্পানিতে। প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্টের সঙ্গে। ওয়াহিদ বললেন, ‘মার্ভেলের নতুন ছবি ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার-এর কাজ শেষ করে এলাম। কানাডায় ফিরে গিয়ে শুরু হবে বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ অভিনীত ডক্টর স্ট্রেঞ্জ-এর কাজ। মজার বিষয় হলো এ বছর সুপারহিরোদের নিয়ে ছয়টি সিনেমা বেরোবে, তার মধ্যে তিনটিতেই কাজ করার সুযোগ পেয়েছি আমি!’
আরও অনেক কাজ মাথায় নিয়ে চলছেন ওয়াহিদ। হলিউডের জন্য একটা সিনেমার গল্প লিখছেন, বাংলাদেশের জন্য একটি সিনেমার চিত্রনাট্যেও হাত দিয়েছেন।
ওয়াহিদের আরও একটা পরিচয় আছে! তিনি কবিতা লেখেন, বইও বেরিয়েছে কয়েকটি। তাঁর একটা কবিতা এ রকম ‘মাটি থেকে যে ফিরে গেছে মেঘে,/ তার কথা মাটিতেই বেশি মনে পরে।/ অতিথি পাখির ঠিকানায়, ধার করা ডানায়,/ মাটির মানুষ হারায়, আহা মাটির মানুষ হারায়।’ ওয়াহিদ ‘আরও বড়’ হয়ে সিনেমায় দেশের গল্প বলতে চান, হারিয়ে যেতে দেবেন না মাটির মানুষকে! তিনি যে বাংলাদেশের ‘সুপারম্যান’!
মন্তব্য চালু নেই