কমিটির ফাইল হাতে নিয়ে হাঁটছেন খালেদা?
দলের কাউন্সিল সম্পন্ন হয়ে গেলেও জাতীয় নির্বাহী কমিটি কখন ঘোষণা করা হবে এ নিয়ে ন্যূনতম কোনও ধারণা নেই বিএনপির নেতাকর্মীদের। খোদ স্থায়ী কমিটির ১৬ সদস্যের মধ্যে কারও কাছেই এ সম্পর্কে কোনও নিশ্চিত খবর নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এ সম্পর্কে তারা যা বলছেন, তা কেবল ‘ধারণা’ থেকে।
তবে ইদানিং সবার নজর কেড়েছে একটি ধূসর রঙের ফাইল; যেটি খালেদা জিয়ার গাড়ি থেকে নামছে তার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের হাত হয়ে। অবশ্য ওই ফাইলটি কখনও শিমুল বিশ্বাসকেও খুলতে দেখা যায়নি। গাড়ি থেকে নেমে ফাইলটি আবার গুলশান কার্যালয়ে চেয়ারপারসনের টেবিলে চলে যাচ্ছে। রাতে অফিসের কাজ শেষ হলে আবার শিমুল বিশ্বাসের হাত হয়ে সেটি চলে যাচ্ছে খালেদার গুলশানের বাসায়।
বিষয়টি কাউন্সিলের দু’একদিন আগে থেকেই লক্ষ্য করছিলেন গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। আর এখন নজরে পড়েছে স্থায়ী কমিটিসহ দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার। তাদের মতে, ওই ফাইলটির ওপরই নিজের মতো করে একে একে নাম বসাচ্ছেন খালেদা জিয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির সিনিয়র এক নেতা জানান, ফাইলটি দেখছি ইদানিং ম্যাডাম নিজেই বহন করছেন। কাউকে ধরতে দিচ্ছেন না। সম্ভবত, বিভিন্ন মাধ্যমে আসা নাম মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি লিখে রাখছেন।
সিনিয়র নেতাদের এই ধারণার আরও কারণ, কমিটি নিয়ে ন্যূনতম কোনও আলাপ-আলোচনা দলের কোনও পর্যায়ে খালেদা জিয়া এ পর্যন্ত করেননি। দু’একজন যারা স্বেচ্ছায় প্রসঙ্গ তুলতে গেছেন, সুকৌশলে এড়িয়ে তাদেরকে দলের জন্য ‘কাজ করতে’ বলেছেন খালেদা। আরও একধাপ এগিয়ে তিনি বলেছেন, কাকে কোন কমিটিতে রাখতে হবে তার তার জানা আছে।
আর গুরুত্বপূর্ণ এই ফাইল নিজের হেফাজতে রাখার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, কমিটিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে ‘বাণিজ্য’ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। কমিটির নামের খসড়া তালিকা তৈরির জন্য গত কয়েক বছর ধরে প্রভাবশালী (বর্তমানে স্থায়ী কমিটির সদস্য) একজন নেতাকে দায়িত্ব দিতেন খালেদা জিয়া। কিন্তু ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর তৈরি করা তালিকায় খালেদার নির্দেশনার বাইরে অন্তত ১৫ ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ ওঠে দলের মধ্যে; যার আড়ালে ‘লেনদেন’ হয়েছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া পৌর নির্বাচন এবং সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরেও দু’একজন নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। সব মিলিয়ে কমিটির খসড়া তালিকা এবার খালেদা জিয়া নিজেই করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
অবশ্য এ নিয়ে আরেক সমস্যার উদ্ভব হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। কারণ তালিকায় নাম বসানোর কাজটি খালেদা জিয়া একা করতে পারবেন না। কারও না কারও সহযোগিতা তাকে নিতেই হবে। তার কাছে থাকেন শিমুল বিশ্বাস। আর শিমুল বিশ্বাসের সহযোগিতা নিয়ে তালিকা করা হলে তা কতটা নির্মোহ বা স্বচ্ছ হবে এ নিয়েও দলের মধ্যে প্রশ্ন আছে। কারণ দলের গ্রুপিং-লবিংয়ে ইতোমধ্যে তার নামও জড়িয়ে পড়েছে। তিনি সমর্থন করছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম বিরোধী বলে পরিচিত গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বাধীন অংশকে।
গত ১৯ মার্চ শনিবার দলটির জাতীয় কাউন্সিলে উপস্থিত কাউন্সিলররা দলের সব পর্যায়ের কমিটি গঠনের দায়িত্ব খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দেন। কনভেনশন অনুযায়ী মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটি, ভাইস-চেয়ারম্যান, উপদেষ্টামণ্ডলীসহ সব কমিটি গঠনের এখতিয়ার এখন তার হাতে। তবে গঠনতন্ত্রে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও পুত্র সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যে এ বিষয়ে তিনি পরামর্শ করবেন এ বিষয়ে দলের কারোরই সন্দেহ নেই। ফলে পদ-পদবির জন্য তদবির লবিং এখন চেয়ারপারসন ও তার ঘনিষ্ঠজনদের পাশাপাশি লন্ডনেও করতে হচ্ছে।
কমিটি কবে হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর জানতে যোগাযোগ করে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুর ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সবচে প্রবীণ দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদের কাছে কোনও জবাব বা দিনক্ষণের খবর পাওয়া যায়নি।
ফখরুলের মতে, সব সময়ই কাউন্সিলের বেশ কিছু সময় পরে নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। চেয়ারপারসন নিশ্চয়ই যাচাই-বাছাই করে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে কমিটি দেবেন। এ নিয়ে তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, নির্বাহী কমিটি বা কোনও কমিটি গঠনের ব্যাপারে দলে আলোচনার কোনও নিয়ম নেই। কাউন্সিলররা এ দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে চেয়ারপারসনকে দিয়েছেন। তিনি যখনই প্রয়োজন মনে করবেন বা গুছিয়ে আনতে পারবেন তখনই কমিটি ঘোষণা করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির এক নম্বর এই সদস্য বলেন, কমিটি নিয়ে যাতে অস্বচ্ছতার প্রশ্ন না ওঠে এজন্য চেয়ারপারসন সম্ভবত এবার খুবই সতর্ক। ফলে এ পর্যন্ত যা মনে হয়; এক হাতেই তিনি সব তদারকি করছেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী ও দুইবার বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। প্রায় ৩০ বছর তিনি বিএনপি পরিচালনা করছেন। সুতরাং কমিটি গঠনের জন্য এখন তার পরামর্শ প্রয়োজন হবে কেন? তিনি নিশ্চয়ই যোগ্যতা ও প্রজ্ঞা বিবেচনা করে উপযুক্ত লোককে উপযুক্ত জায়গায় দেবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিটি নিয়ে আগ্রহী প্রার্থী বা নেতাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা থাকা স্বাভাবিক। তবে চেয়ারপারসনের এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করার সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির মধ্যে মারা গেছেন ড. আর এ গনি এবং খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মোট তিনটি পদ খালি হয়েছে।
অন্যদিকে বয়স ও অসুস্থতার কারণে দলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন এম. শামসুল ইসলাম ও বেগম সারোয়ারি রহমান। এর মধ্যে শামসুল ইসলাম নিজেই ওই পদে আর থাকতে আগ্রহী নন। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, স্থায়ী কমিটিতে মোট পাচঁটি শূন্য পদে এবার নতুনদের অন্তর্ভুক্ত করবেন খালেদা জিয়া।
জানা গেছে, দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী এই ফোরামে অন্তর্ভুক্তি নিয়েও স্থায়ী কমিটির অন্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেননি খালেদা। ফলে ওই পদে কারা আসবেন তা নিয়ে স্থায়ী কমিটিইে উৎকণ্ঠা রয়েছে। বাংলাট্রিবিউন
মন্তব্য চালু নেই