টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি আজ ‘জাতির পিতা’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোনো সীমারেখায় আটকে যে নামের বন্দনা করা যায় না। তিনি জন্মেছিলেন বাঙালির মুক্তির তাগিদেই। তবে শুধু জাতিসত্ত্বার প্রশ্নেই নয়, তিনি এসেছিলেন মানবমুক্তির কেতন উড়িয়ে। কেউ কি সেদিন ভেবেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার ঐ ছেলেটি একদিন বাঙলী জাতির পিতা হবে! আওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে তার সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো।
১৯৩৯ সালের কথা। গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক, স্কুল পরিচালনা পর্ষদ সবাই ব্যস্ত। স্কুলের ক্লাশরুম, বারান্দা, পায়খানা- প্রসাবখানা সব ঝকঝকে পরিস্কার। গাছ থেকে একটি ঝরা পাতা উড়ে এসে বারান্দায় পড়লে হেড মাস্টার সাহেব কাউকে কিছু না বলে নিজেই ঝট করে পাতাটা তুলে ফেলছেন।দু’সপ্তাহ আগেই ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেওয়া হয়েছে সেদিন যেন সকলে পরিস্কার-পরিছন্ন মার্জিত পোষাক পড়ে স্কুলে হাজির হয়। কারণ ঐদিন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক স্কুল পরিদর্শনে আসবেন সাথে থাকবেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী । ভালোয় ভালোয় স্কুল পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী মহোদ্বয় ডাক বাংলার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন এমন সময় একদল ছাত্র এসে হঠাৎ তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ালো। ছাত্রদের এমন কান্ড দেখে হেড মাস্টার সাহেব তো রিতিমত ভরকে গেলেন। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোমরা কী করছ রাস্তা ছেড়ে দাও।।’ ছাত্ররা হেড মাস্টারের কথায় কর্ণপাত না করে হ্যাংলা পাতলা লম্বা ছিপছিপে মাথায় ঘন কালো চুল ব্যাক ব্রাশ করা একটি ছেলে গিয়ে দাঁড়ালো একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মুখে । মন্ত্রী মহোদয় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কি চাও ? বুকে সাহস নিয়ে নির্ভয়ে সে উত্তর দিল, ‘ আমরা গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশনারি হাই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুয়িয়ে পড়ে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়।ক্লাশ করতে অসুবিধা হয়।স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোন ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা মুক্ত করা হবে না। কিশোর ছাত্রের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব , সৎ সাহস আর স্পষ্টবাদীতায় মুগ্ধ হয়ে হক সাহেব জানতে চাইলেন, “ ছাদ সংস্কার করতে তোমাদের কত টাকা প্রয়োজন?” সাহসী কন্ঠে সে জানাল, “ বার শ’ত টাকা। মুখ্য মন্ত্রী প্রতুত্তরে বললেন , ‘ ঠিক আছে , তোমরা যাও।আমি তোমাদের ছাদ সংস্কারের ব্যবস্থা আমি করছি। তিনি তাঁর তহবিল থেকে উক্ত টাকা মঞ্জুর করে অবিলম্বে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন। এমনি এক দাবী আদায়ের মধ্য দিয়ে যার জীবনযাত্রা শুরু এই ছাত্রনেতা তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উল্লেখ যোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু সে সময়ে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশনারি হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
নারকেল-সুপারী বনবীথির ছায়াঘেরা মধুমতির তীর ছোয়া সবুজ শ্যামল গ্রাম টুঙ্গিপাড়া । তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। অনেক জ্ঞানি-গুণী, কবি-সাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক-রাজনীতিবিদ জন্ম গ্রহণ করেন ফরিদপুরে।উল্লেখ যোগ্য ব্যাক্তিত্বের মধ্য যুগীয় প্রখ্যাত কবি আলাওল, পল্লীকবি জসিম উদ্দিন,প্রসিদ্ধ ধর্মীয় উপন্যাস ‘বিষাদ-সিন্ধু’ র রচয়িতা মীর মশররফ হোসেনের জন্ম ফরিদপুরে না হলেও তিনি তাঁর বাল্যকাল কাটিয়েছেন ফরিদপুরে,প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যিনি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন, ফরায়েজি আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাজী শরীয়তুল্লা ও তাঁর ছেলে মুহম্মদ মহসীন দুদুমিয়া, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন,মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ,চিত্র নায়িকা রোজিনা প্রমুখ। এই ফরিদপুরেরই কৃতি সন্তান শেখ মুজিব । বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের সংসারে চার বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় । তার বড় বোন ফাতেমা, মেজ বোন আছিয়া, সেজ বোন হেলেনা ও ছোট বোন লাইলী বেগম। একমাত্র ছোট ভাইয়ের নাম ছিল শেখ আবু নাসের। তখনকার দিনে বাবা-মা বড় ছেলেকে আদর করে ডাকতেন ‘খোকা।’ সেই হিসেবে শেখ মুজিবের ডাক নাম ছিল ‘খোকা।’ কথিত আছে, শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষ ছিলেন শেখ আউয়াল। যিনি মোঘল শাসন আমলে বাগদাদ থেকে বাংলায় আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে। সেই শেখ আউয়ালেরই বংশধর শেখ আব্দুল হামিদ। শেখ আব্দুল হামিদের পুত্র শেখ লুৎফর রহমান যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা। শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার ( হিসাব রক্ষক) ছিলেন। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। শেখ মুজিবের জীবনে পিতার আদর্শ বিরাট ভূমিকা রেখেছে। অন্যায়, অসত্য, নির্যাতন, ভয়-ভীতির কাছে কখনও মাথা নত করেননি শেখ লুৎফর রহমান ।
টুঙ্গিপাড়ার শ্যামল পরিবেশে শেখ মুজিবের জীবন কাটে দুরন্তপনা করে।মধুমতির ঘোলাজলে গাঁয়ের ছেলেদের সাথে সাঁতার কাটা,দৌড়-ঝাপ, দল বেঁধে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ভলিবল খেলায় তিনি ছিলেন দস্যি বালকদের নেতা। তখন কে জানত এই দস্যি বালকদের নেতাই একদিন বিশ্বনেতা, বাঙালি জাতির পিতা হবেন? শেখ মুজিব অনেকটা দেরিতে পড়ালেখা শুরু করেন । গৃহ শিক্ষক মৌলবি সাখাওয়াৎ উল্লাহর কাছে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি।১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন তার বয়স সাত বছর।১৯৩১ সালে বাবা লুৎফর রহমান পরিবারবর্গ নিয়ে আসেন তাঁর কর্মস্থল গোপালগঞ্জ। খোকাকে ভর্তি করে দেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ।এখানে বছর দেড়েক যেতে না যেতেই খোকা আক্রান্ত হলো বেরিবেরি রোগে।এই বেরিবেরি রোগ থেকেই তার চোখে জটিল অসুখ দেখা দেয়। যার নাম ‘গ্লোফুমা।’ পূত্র স্নেহে পিতা লুৎফর রহমান অস্থির হয়ে পড়লেন। শুভাকাংখিরা পরামর্শ দিলেন খোকাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কলকাতা তখন ছিল বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী।সেখানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চক্ষু বিশেজ্ঞ ডাঃ টি আহমেদ তার চোখের সার্জারি করেন এবং তিঁনি সুস্থ হয়ে উঠেন।গ্লোফুমা থেকে সুস্থ হলেও ডাক্তার তাঁকে চোখে চশমা ব্যাবহারের পরামর্শ দিলেন।চোখে অসুখের কারণে ১৯৩৪ থেকে চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হন। এই স্কুলে থাকাকালীন সময়েই তাঁর প্রতিভা আর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। এমনিতেই ক্লাশের অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে কিছুটা বয়সে বড় সেই সাথে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা সকলকে মুগ্ধ করে। সকলের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন তিঁনি। তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে ‘মুজিব’ ভাই হিসেবে।
আগেই বলেছি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যখন গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুল পরিদর্শনে আসেন তখন তাঁর সাথে ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। । শেখ মুজিব যখন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের সাথে বাদানুবাদ করছিলেন তিঁনি পিছনে দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করছিলেন।শেখ মুজিবের সৎসাহস, কর্তব্যবোধ তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। ডাকবাংলায় ফিরেই তিঁনি শেখ মুজিবকে ডেকে পাঠালেন। তিঁনি তাঁর সাথে কিছুক্ষণ ক্থা বললেন এবং কলকাতায় তাঁর সাথে দেখা করতে বললেন। পরবর্তীতে এই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরেই শেখ মুজিব রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
স্কুল জীবনেই শেখ মুজিব প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। মুজিব যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র এসময়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁকে মিথ্যে অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। সম্ভবতঃ এটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম গ্রেফতার। পরে ছাত্রদের চাপের মুখে পুলিশ শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর মেয়াদের জন্য কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে শেখ লুৎফর রহমানের ‘খোকা’ শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুল থেকে প্রবেশিকা (বর্তমান স্কুল মাধ্যমিক)পাশ করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল।
মন্তব্য চালু নেই