ইটভাটাগুলোতে চাপা পড়ছে শিশুর ‘রঙিন’ ভবিষ্যৎ

কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনোবা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন। শিা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কন্যা শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্যসঙ্গী।
টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার ইটভাটাগুলোতে বছরের বড় একটা সময় জুড়ে চলে শিশু শ্রমের মহাযজ্ঞ। এ যজ্ঞের আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে হাজার হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ। ইটভাটার মালিকরা কম মজুরিতে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার লোভে শিশুদেরই ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে জড়াচ্ছেন।
দারিদ্রের বেড়াজালে বন্দি হয়ে ইটভাটাগুলোতে চাপা পড়ছে এসব শিশুর ‘রঙিন’ ভবিষ্যৎ। যে বয়সে তাদের থাকার কথা বাবা মায়ের আদরে, সেখানে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এতে শিার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এসব শিশুরা।
ঘাটাইল উপজেলার পৌর সদর সহ দেউলাবাড়ী, পাকুটিয়া, হ্মমণশাসন, হামিদপুর, মোগলপাড়া সহ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর বেলা রোদের মধ্যে কাজ করছে একদল শিশু। এদের সবারই বয়স ৮ থেকে ১৬ বছর। জীবন-জীবিকার তাগিদে কেউ এসেছে তার মা-বাবার সঙ্গে, কেউ শ্রমিক সরদারের সঙ্গে।
এসব শিশুরা ইটভাটাগুলোর আশেপাশের ভিবিন্ন এলাকা থেকে এসেছে ছয় মাসের কাজের চুক্তিতে। চুক্তি ফুরালেই আবার ফিরবেন আপন ঘরে। তবে ততো দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হবে পুরোমাত্রায়।
ঘাটাইলের সব ইটভাটাতেই ভাটার বড় শ্রমিকদের পাশাপাশি কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করাসহ সব কাজেই নিয়োজিত আছে এই শিশুরা। প্রত্যেক কাজই বড়দের মতো করে করতে হয় তাদের।
ছোট বেলা থেকেই ইটভাটায় কাজ করতে করতে যেমন শিা থেকে ছিটকে পড়ছে এখানকার শিশুরা, ঠিক তেমনি কাজ করতে করতে মারাত্মক সব রোগের শিকার হতে হচ্ছে ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা। শিশুকাল তাদের মনের পাশাপাশি শরীরেরও গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে। কিন্তু ভাটার শিশুদের মন ও শরীর দুটো আক্রান্ত হয় রোগে-শোকে।
ঘাটাইল জেনারেল হাসপাতালের এক শিশু বিশেষজ্ঞ জানান, ঘাটাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ইটভাটায় দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, এজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জানাযায়, শ্রম আইন-২০০৬ এর ২৮৪ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে, অথবা আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশুকে চাকরি করার অনুমতি দিলে, তিনি ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ঘাটাইল এমএসবি ভাটার মালিক সোহরাব হোসেন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, অধিকাংশ ইটভাটাতেই শিশু শ্রমিক নেই, তবে কিছু শিশু আছে যারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে আসে। এেেত্র তাদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রায় ৫৪টি ধারার মধ্যে সরাসরি শিশুর সুরা বিষয়ক ২৪টি ধারা রয়েছে। ধারা ৩২-এর ১-এ বলা আছে, শরীক রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকারকে রা করবে এবং শিশুর শিায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কিংবা তার স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য তিকর কাজ করানো না হয়, সে ব্যবস্থা নেবে।
এই শিশু অধিকার সনদে স্বারকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এখনো দেশে এই সনদের বাস্তবায়ন হয়নি। শিশুরা এখনো অরতি, এখনো গড়ে ওঠেনি আলাদা মন্ত্রণালয়।


মন্তব্য চালু নেই