বাইসাইকেলে হজে যাওয়ার ইচ্ছা জাফর ফরাজীর (ভিডিওসহ)
এক সময় পায়ে হেঁটে কিংবা জাহাজে করে সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র হজব্রত পালন করতেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। যুগের বিবর্তনে তা এখন অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। বর্তমান অত্যাধুনিক এই যুগে বিমান ছাড়া পাশের দেশ ভারত বা মিয়ানমারেও যাওয়ার কথা তেমন কেউ ভাবেন না। তবে পায়ে হেঁটে নয়, আধুনিক উৎকর্ষতার এই যুগে বাইসাইকেল চালিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র হজ পালন করতে চান বাংলাদেশের ৬৪ বছর বয়সী জাফর ফরাজী। মনের দিক থেকে এখনো তরুণ এই মানুষটি। সাত সমুদ্র তের নদী নয়, ৮-৯টি দেশের পাহাড়-পর্বত ও দুর্গম পথ মাড়িয়ে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল চালিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র হজ পালনের অন্তিম ইচ্ছা তার।
বাপ-দাদার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার পূর্ব কমলাপুর গ্রামের জাফর ফরাজী পরিবারসহ বসবাস করেন নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার একরামপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন তিনি। পেশায় একজন দর্জি। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবিকারী জাফর ফরাজীর সঙ্গে কথা হয় গত ৭ মার্চ। খরব: দ্য রিপোর্ট
জাফর ফরাজী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সেলিম কমান্ডারের (স্পেন প্রবাসী) অধীনে ’৭১-এর রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু যুদ্ধ শেষে বাড়ি চলে যাওয়ায় (মাদারীপুর) পরবর্তী সময়ে আর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম ওঠেনি। এরপর বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে দিল্লিতে চলে যাই। সেখানে প্রায় ৩২ বছর কাটিয়ে ২০০৭ সালে বাংলাদেশে চলে আসি।’
তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে দিল্লিতেই থাকেন সপরিবারে। মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছেন। আর ছোট দুই ছেলে নারায়ণগঞ্জেই গার্মেন্টসে কাজ করেন।
জাফর ফরাজী বলেন, এ পর্যন্ত চারবার বাংলাদেশের ৬৪ জেলা বাইসাইকেল চালিয়ে ভ্রমণ করেছেন। একবার ভারতের আজমীর সফর করেছেন বাইসাইকেল চালিয়েই। পঞ্চমবারের মতো ফের পুরো দেশ সফর করছেন তিনি।
তিনি বলেন, আগে মানুষ পায়ে হেঁটে পবিত্র হজ করতে সৌদি আরবে যেতেন। আমার ইচ্ছে জাগল বাইসাইকেল চালিয়ে হজ সৌদি আরবে যাব। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় একবার চেষ্টাও করেছিলাম। তখন দিল্লি থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই দুই দেশের যুদ্ধের কারণে তা হয়নি। ২০০৭ সালে দেশে ফেরার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশগড়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমার যেটুকু বাড়ি-ঘর ছিল তা বিক্রি করে সমাজ সেবায় নিয়োজিত হই। এরপর আগের সেই ইচ্ছে মনের মধ্যে জাগ্রত হয়। বাইসাইকেলে করে পবিত্র হজ করতে সৌদি আরবে যেতে পারব কিনা— তা টেস্ট করার জন্য প্রথমে সারাদেশ সাইকেল চালিয়ে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেই।
২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ৬৪ জেলা সফরের জন্য বাইসাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। ৬৪ জেলা বাইসাইকেলে ঘুরতে প্রায় সাড়ে ৫ মাস লেগে যায়। এ সময় প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে প্রত্যায়নপত্র নেই আমি।
জাফর ফরাজী বলেন, দ্বিতীয়বার ৬৪ জেলা সফর করেছি এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহিমের সঙ্গে। আমরা ২০ জন সাইকেল চালিয়ে এক মাস ৬৪ জেলা সফর করেছি। তৃতীয়বার প্রায় একই সময়ের মধ্যে (এক মাসে) ৬৪ জেলা সফর করেছি। এরপর পবিত্র হজ পালনের জন্য ভারত ও ইরানের ভিসা মিললেও পাকিস্তান ভিসা দেয়নি। এ কারণে থেমে যায় বাইসাইকেলে করে সৌদি আরবে যাওয়ার প্রক্রিয়া। এর প্রতিবাদে চতুর্থবার ফের ৬৪ জেলা বাইসাইকেলে সফর করি। সাড়ে ৩ মাসব্যাপী এই সফরে প্রত্যেক জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করি। বর্তমানে পঞ্চমবারের মতো ৬৪ জেলা সফরে বের হয়েছি— জানান তিনি।
বার বার এই সফরে অর্থ কোথা থেকে আসে এবং কোথায় কীভাবে থাকেন— জানতে চাইলে ৬৪ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ বলেন, প্রথম তিনবারের টাকা আমার বড় ছেলে জুগিয়েছে। এরপর আমি মানুষের কাছ থেকে চেয়ে সারাদেশ সফর করেছি। সফরের সময় যেখানে রাত হয়েছে ওই এলাকার মার্কেটের ফুটপাতেই ঘুমিয়ে নিয়েছি। যদিও একবার আমার কিছু টাকা খোয়া গিয়েছিল।
জাফর ফরাজী বলেন, তার অন্তিম ইচ্ছা বাইসাইকেল চালিয়ে হজ করবেন। এ জন্য সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপুমনি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ আরও অনেক এমপি-মন্ত্রীর ডিও লেটার ও সুপারিশ নিয়েছি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারিনি। আমার বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ইচ্ছার কথা বলতে পারলে তিনি অবশ্যই আমাকে বাইসাইকেলে করে পবিত্র হজ করতে সৌদি আরবে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। সেখানে আমার যাওয়া আসার সকল খরচ ও ভিসার ব্যবস্থা করে দিবেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারছি না, যোগ করেন তিনি।
বাইসাইকেলে সৌদিতে যাওয়ার সর্বশেষ প্রক্রিয়া কোন অবস্থায় আছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি আমাকে বলেছেন, আফগানিস্তান আর ইরাক বাদ দিয়ে আমাকে ভিসা লাগিয়ে দিবেন। ভারত, চীন, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিমিনিস্তান, ইরান, কুয়েত হয়ে সৌদি আরবে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান ভিসা দেয়নি। ডিজি স্যার বললেন আরও দুইটা দেশ (যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান-ইরাক) বাদ। আর এ দুটি দেশ বাদ দিতে গিয়ে দেশের সংখ্যা ও পথ বেড়ে গেছে। সাড়ে ১৩ হাজার কিলোমিটার পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে সৌদি আরবে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করে জাফর ফরাজী বলেন, তিনি যদি আমাকে দয়া না করেন এবং ভিসা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি বিনা পয়সায় রওনা হয়ে যাব। প্রয়োজনে খেয়ে না খেয়েই সৌদি আরবের দিকে সাইকেল নিয়ে রওনা হব।
জাফর ফরাজী সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে ভিডিও সাক্ষাৎকারটি দেখুন
https://youtu.be/q8WMA60NJ0Q
মন্তব্য চালু নেই