উপেন্দ্রকিশোরের শততম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন বাংলা শিশু সাহিত্যের অমর প্রাণ। বাংলা মুদ্রণশিল্পেরও অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। তিনিই প্রথম ভারতে কালার ও আধুনিক প্রিন্টারের প্রচলন করেন।এ ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার। প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবসায়ী হিসাবেও পরিচিতি ছিল তার। প্রখ্যাত এই শিশুসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীর শততম প্রয়াণ দিবস আজ। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।

লেখক হিসাবে লোকগাথার জন্য বিশেষ পরিচিতি ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম ম্যাগাজিন ‘সখা’। শিশু সাহিত্যই ছিল তার লেখনীসৃষ্টির মূল বিষয়। সৃষ্টি করেছেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ও ‘টুনটুনির বই’-এর মত অনবদ্য শিশু সাহিত্য। তার বিখ্যাত কিশোর সাহিত্য পত্রিকা ‘সন্দেশ’। বিজ্ঞান সম্বলিত তার সেরা দু’টি ক্লাসিকস ‘সেকালের কথা’ ও ‘আকাশের কথা’।

আমাদের গর্ব যে, প্রখ্যাত এই শিশুসাহিত্যিকের জন্ম এই বাংলাদেশে। ১৮৬৩ সালের ১০ মে ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে জন্ম তার। তার পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন ও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপন্ডিত। পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্র ছিলেন তৃতীয়। তার পিতৃ প্রদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তার পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা তিনিই শুরু করেন যা পরে তার পুত্র সুকুমার রায় ও পৌত্র সত্যজিৎ রায় সম্পাদনা করেন। বলা হয়, বাংলা শিশু সাহিত্যে ‘সন্দেশ’ একটি মাইলস্টোন।

মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভাল ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে।

একুশ বছর বয়সে বিএ পাস করে ছবি আঁকা শিখতে আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। এই সময় তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হওয়ায় অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে তার। ছাত্র থাকাকালীনই তিনি ছোটোদের জন্যে লিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময়কার ‘সখা’, ‘সাথী’, ‘মুকুল’ ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ নামে মাসিক পত্রিকাগুলিতে তার লেখা প্রকাশ হতে শুরু করে। প্রথমদিকের (যেমন সখা, ১৮৮৩) প্রকাশিত লেখাগুলি ছিল জীববিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। তার পরে চিত্র অলঙ্করণযুক্ত গল্প প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীর বিবাহ হয়। তখনকার কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের বিপরীতে কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে উপেন্দ্রকিশোরেরর সংসার জীবন শুরু হয়। উপেন্দ্রকিশোরের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা হলেন সুকুমার, সুবিনয় ও সুকোমল, এবং মেয়েরা হলেন সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।

তার প্রথম বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের সিটি বুক সোসাইটি থেকে। এই বইটি সমাজে অতি আদরের সঙ্গে সমাদৃত হলেও মুদ্রণ সম্বন্ধে তৃপ্ত হতে পারেননি উপেন্দ্রকিশোর। ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে তখনকার দিনের আধুনিকতম মুদ্রণযন্ত্রাংশাদি নিজের খরচায় আমদানি করেন এবং ৭ নম্বর শিবনারায়ণ দাস লেনে নতুন ভাড়াবাড়ি নিয়ে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামে নতুন ছাপাখানা খোলেন। এখানের একটি কামরায় তিনি নিজের আঁকার স্টুডিও খোলেন এবং সেখানে হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন। ১৯১১ সালে তিনি বড় ছেলে সুকুমারকে বিলাতে পাঠান ফোটোগ্রাফি ও মুদ্রণ সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্যে। আজকের সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রগতির মূলে ছিল উপেন্দ্রকিশোরের সেদিনের এসব কর্মকান্ড।



মন্তব্য চালু নেই