শমসের মবিনের পদত্যাগ: কোনপথে বিএনপি?

প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে আছে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি। অন্যদিকে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির চলতি সঙ্কটের শুরু মূলত সর্বশেষ সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু করে ব্যর্থ হয়ে তার জের এখনো টানছে দলটি।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে ওই নির্বাচনের বছরপূর্তিতেও জোট নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল বিএনপি। ওই দফার আন্দোলনও ছিল ব্যর্থ। এরপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে দল গোছানোয় মন দেয় বিএনপি, যদিও দলের প্রায় সব নেতার মাথায় রয়েছে মামলার বোঝা, কারো কারো শতাধিক। শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত প্রায় আট বছর ধরে আছেন লন্ডনে, মির্জা ফখরুল জামিনে মুক্ত থাকলেও কারাগারে আছেন রুহুল কবির রিজভী। গেল মার্চে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর এখন শিলংয়ে দিন কাটছে সালাহ উদ্দিন আহমদের। মির্জা আব্বাস রয়েছেন পলাতক। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, হান্নান শাহসহ বেশ কজন নেতা রয়েছেন নিষ্ক্রিয়।

অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরীক জামায়াতে ইসলামীও পার করছে কঠিন এক সময়। এই দলটির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই-ই মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত, বিচার চলছে তাদের; যা ক্ষমতাসীনদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল।

এমন এক সঙ্কটকালীন সময়ে হঠাৎ করেই বৃহস্পতিবার বিএনপির সঙ্গে দাপ্তরিক সব সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। তাৎক্ষণিকভাবেই মবিনের এই বিদায়কে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। বৃহস্পতিবার দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম বিএনপিকে ঢেলে সাজানো উচিৎ। কারণ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের উপর থেকে দলীয় নেতাকর্মীরা অনেক আগেই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। শমসের মবিনও খালেদার প্রতি আস্থা হারিয়ে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন।’

অবশ্য বুধবার রাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে মবিন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে যে চিঠিটি দিয়েছেন তাতে শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখানো হয়েছে।

শমসের মবিনের পদত্যাগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এক-এগারোর সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ থেকে অনেক নেতাই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হয়নি। ফলে কোনো ব্যক্তি বিশেষ দল থেকে চলে গেলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।

খন্দকার মাহবুবের এমন বক্তব্যে বিএনপির জন্য আপাত দৃষ্টিতে কোনো দুশ্চিন্তার কারণ না পাওয়া গেলেও দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র একইভাবে আরো নেতা চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। তবে চলে যাওয়ার এই দলে কারা থাকবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় সূত্রটি। বলা হচ্ছে, দলে সঠিক নেতৃত্বের অভাব ও মামলার কারণে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ স্থানীয় নেতাকর্মী। ফলে বিএনপিতে দেখা দিয়েছে ভাঙনের সুর। যার ফলশ্রুতিতে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করছেন। ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা তাই অনেকের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে।

তবে খন্দকার মাহবুব বলছেন, শমসের মবিনের বিএনপি থেকে সরে যাওয়াতে দল চিন্তিত নয়।

বিএনপির আরো অনেক নেতার দল ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বা শঙ্কা নিয়ে দলের যুব বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বিএনপির কোনো নেতাকে আগাম চিহ্নিত করা মুশকিল। কারণ, বেগম জিয়ার সঙ্গে সফর করে এসেই তার পরদিন অনেক নেতাই এরশাদ সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তাই আগাম কিছু বলা সম্ভব নয়। হলেও হতে পারে।

বিএনপির অনেক নেতাই রাজনীতিতে সেভাবে আর সক্রিয় নন, ধীরে ধীরে তারাও সড়ে দাঁড়াতে পারেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আলাল বলেন, যদি কেউ চলেও যান তাতে মূল স্রোত, অথ্যাৎ বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না।

এই বিষয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ ছেড়ে অনেক নেতাকর্মীই খুব শিগগির চলে যাবেন, এই কথা আমার কানে এসেছে। তবে আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি বিএনপি ছেড়ে কেউ যাবে না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের দু’জন উপদেষ্টা এই প্রতিবেদককে বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে সরে এসেছে বিএনপি। তাই আজ বিএনপির এই দুরাবস্থা। আর এই একই অভিযোগে গতকাল শমসের মবিন চৌধুরী দলের সকল কর্মকাণ্ড থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে তা আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

শুক্রবার বিকেলে সিলেটে মবিনের বিষয়ে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বিএনপিতে অনেক কূটনৈতিক রয়েছে। উনার পদত্যাগে দলে কোনো প্রভাব পড়বে না।

আবার শমসের মবিনের পদত্যাগের বিষয়টিকে নাটক বলে আখ্যায়িত করেছেন সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের নেতারা। এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, দেশ ও জাতির চরম ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র যখন বিপন্ন, অর্থনীতি বিপর্যস্ত সেই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ হীন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের অংশীদার হয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদধারী শমসের মবিন চৌধুরী স্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে ‘অবসর’ নাটকের অবতারণা করেছেন। অতীতে বিভিন্ন সময় তার বিতর্কিত মন্তব্য, কর্মকাণ্ড, আন্দোলন চলাকালীন স্বেচ্ছায় নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া, নেতাকর্মীদের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে উসকানি দেয়া ও বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের মাধ্যমে দলকে বারংবার বিব্রত করার কারণে দলের আপামর নেতাকর্মীরা তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা সম্পর্কে সবসময় সন্দিহান ছিলেন। অবশেষে দলকে বিতর্কিত করে সরকারের উদ্দেশ্য পূরণের প্রয়াস সর্বশেষ ‘অবসর’ নাটকের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো।

মবিনের চিঠির জবাব খালেদা দেশে ফিরলেই

তারেকের উপেক্ষায় মবিনের অভিমান!



মন্তব্য চালু নেই