বরিশালে বাজারজাত হচ্ছে গৌরনদীর ভার্মিকম্পোস্ট জৈব সার
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়ে দিন দিন মাটি তার নিজস্ব গুনাগুন হারিয়ে ফেলছে। মাটির উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় শস্যের বাড়তি ফলন না পেয়ে দিন দিন কৃষকের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এমনই সময় সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আইএপিপি, ডিএই প্রকল্পের মাধ্যমে মাটির নিরাপদ স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন কর্মসূচী।
সূত্রমতে, গরু ও বিশেষ প্রজাতির কেঁচোর মল দিয়ে তৈরি জৈব সার ভার্মিকম্পোস্ট বেশ স্বল্পসময়ে বাজারজাত করণের পর এ সার জমিতে প্রয়োগ করে বেশ সফলতা অর্জন করেছেন কৃষকেরা। ফলে দিন দিন এ সারের চাহিদা কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভার্মিকম্পোস্ট নামের জৈবসার উৎপাদন ও বিশেষ প্রজাতির কেঁচো বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সর্বপ্রথম বাজারজাত করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের কৃষক ক্লাবের অর্ধশতাধিক সদস্যরা।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ভার্মিকম্পোস্ট (কেঁচো সার) উৎপাদনের কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল আজিজ ফরাজি। ওইদিন দুপুরে দক্ষিণ মাহিলাড়া গ্রামের সফল কৃষক বিপুল হালদারের বাড়িতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কৃষি বান্ধব ও দু’বারের শ্রেষ্ঠ মাহিলাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু।
ওই সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিবিদ মো. আব্দুল আজিজ ফরাজি বলেন, ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুনাগুন বৃদ্ধি করে। মাটির পিএইচের মাত্রা নিয়ন্ত্রণসহ মাটির বিষক্রিয়া দূর করে মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা বাড়ায়। জমিতে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারের ফলে মাটির গঠন উন্নত করে অধিক ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি ফসলের গুণগতমান ভালো হয়। এ সারের গুণাগুণ মাটিতে দীর্ঘদিন অবশিষ্ট থাকায় পরবর্তী ফসলে সারের পরিমান অনেক কম লাগে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
একই সভার বিশেষ অতিথি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈ বলেন, ভার্মিকম্পোস্ট জৈব পদার্থের একটি উৎস যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির সঙ্গে শস্য উৎপাদনের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উৎপাদন সরবরাহ করে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি সহায়ক প্রকল্পের মনিটরিং অফিসার কৃষিবিদ হরিদাস শিকারী বলেন, একক মাত্রার ভার্মিকম্পোস্টে নাইট্রোজেন-২.৯%, ফসফরাস-২.২%, পটাসিয়াম-২.৩%, সালফার-২.৬%, ক্যালসিয়াম-৭.৪%, ম্যাগনেসিয়াম-১.৫%, দস্তা-০.৫% এবং বোরন-০.৯% বিদ্যমান থাকে।
গৌরনদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ফসল ভেদে যেকোন ফসলের জন্য প্রতি শতক জমিতে ৩ থেকে ৫ কেজি হারে ভার্মিকম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ওই জমিতে আগের চেয়ে অর্ধেক রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেই চলে। এ নিয়মে ৩ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করলে পরবর্তীতে জমিতে আর রাসায়নিক সার ব্যবহার না করলেও চলবে।
উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি অফিসার কৃষক বন্ধু মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে ওই ইউনিয়নের কৃষকেরা তাদের ফসলি জমি ও পানের বরজে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন। যে কারণে কৃষকদের মধ্যে দিন দিন এ সারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় কৃষক বান্ধব ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলুর আর্থিক সহযোগীতায় মাহিলাড়া ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক কৃষকেরা এখন ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন করে বাজারজাত করছেন। কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের মাত্রা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ভার্মিকম্পোস্টের কোন বিকল্প নেই বলেও তিনি অভিমত ব্যাক্ত করেন।
ভর্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদনকারী কৃষক রনজিত বেপারী জানান, কৃষি অফিস ও ইউপি চেয়ারম্যানের আর্থিক সহযোগীতায় তিনি প্রথমে তার বাড়িতে তিনটি চাকায় ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেন। প্রতিটি চাকায় ৪৫ কেজি আধা কাঁচা গোবরের মধ্যে থাইল্যান্ডের এক’শ কেঁচো (প্রতি পিচ তিন টাকা) ছেড়ে দেয়া হয়। মাত্র দু’মাসের মধ্যে প্রতিটি চাকায় ওই এক’শ কেঁচোর ডিম থেকে কয়েক হাজার বাঁচ্চা কেঁচো জন্ম নেয়।
বর্তমানে তার প্রতিটি চাকায় প্রায় আট থেকে দশ হাজার কেঁচো রয়েছে। ওই কোঁচোদের মল থেকেই ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন করা হয়। মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু জানান, ভার্মিকম্পোস্ট জৈব সারগুলোর গুনগত মান অত্যন্ত ভাল হওয়ায় তিনি তার নিজ বাড়িতেও এ সার উৎপাদন শুরু করেছেন। তিনি আরও জানান, স্থানীয় পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে সারগুলো বিক্রয়ের জন্য প্যাকেটজাত করে প্রতি কেজি মাত্র পনের টাকা মূল্যে নির্ধারন করে বাজারজাত করা হচ্ছে।
মাহিলাড়া বাজারের সার ব্যবসায়ী তোতা মিয়া জানান, কৃষকদের মধ্যে ভার্মিকম্পোস্ট সারের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সূত্রমতে, বর্তমানে বরিশালের অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও ব্যাপক হারে ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদিত হচ্ছে। তবে মাহিলাড়া ইউনিয়ন থেকেই ওইসব উপজেলার উদ্যোক্তারা বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ক্রয় করে নিচ্ছেন।
মন্তব্য চালু নেই