জেনে নিন, পাহাড়ি বাজারগুলো কেমন হয়

পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে প্রতিটি জিনিস আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। হতে পারে তা খাদ্যদ্রব্য, বনজঙ্গল, নদীনালা এমনকি মানুষ পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই শহর-বন্দর, হাট-বাজারও এর বাইরে নয়। আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বাজারগুলোর রয়েছে ভিন্ন এক বৈশিষ্ট্য। একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাজারগুলোর চেয়ে এগুলো অনেকটাই আলাদা।

বান্দরবানের রুমা বাজার তেমনই একটি। জেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কি.মি.। বাজারে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল, একটি মাত্র মাছ নিয়ে বসে আছেন এক বিক্রেতা। জেলা সীমান্তবর্তী রাঙ্গামাটির রাইক্ষং লেক থেকে শিকার করা গজার মাছটির ওজন ছয় কেজি। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই মাছটি বিক্রি হয়ে গেল। বিক্রেতার অভিব্যক্তি থেকে আন্দাজ করা গেল, প্রত্যাশার চেয়েও অধিক দাম তিনি পেয়েছেন। কততে বিক্রি করলেন, জিজ্ঞেস করতেই সে ডান হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে পাঁচ আঙুল ফাঁক করে বলল, পাঁচশ টাকা!

স্থানীয় অন্যান্য বাজারের তুলনায় রুমা বাজার বেশ জমজমাট।নদী পারাপারের সেতুটির কাজ সম্পন্ন হওয়ায় বাজারের চেহারায় খানিক পরিবর্তন এসেছে। জুতা-স্যান্ডেল থেকে শুরু করে টেলিভিশন ও ডিভিডি প্লেয়ার পর্যন্ত পাওয়া যায়। বাজারটি দুটি অংশে বিভক্ত। এক পাশে বাঙালিদের দোকানপাট, অন্য পাশে পাহাড়িদের। বাঙালি দোকানগুলোর মালিক প্রায় সবাই সাতকানিয়া থেকে যাওয়া। পাহাড়িদের দোকানে যে পণ্যগুলো বিক্রি হয় এর অন্যতম হলো ‘নাপ্পি’। এই আইটেম ছাড়া তাদের খাবার থাকে অসম্পূর্ণ। তেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যে কোনো প্রকার তরকারিতে নাপ্পি ব্যবহৃত হয়। উৎকট গন্ধের এই উপকরণ বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি থেকে তৈরি হয়। এর প্রক্রিয়া জানতে চাইলে দোকানি বাদল ত্রিপুরা জানান, প্রথমে শুঁটকি গুঁড়া করতে হয়। তারপর বিশেষ পদ্ধতিতে একে মণ্ডে রূপ দেয়া হয়। এরপর সেই মণ্ড কেটে কেটে বিক্রি করা হয়। পার্বত্য এলাকায় ম্যালেরিয়া বেশি হয়। নাপ্পিকে এখনও তারা ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচনা করে।

থানচী বাজারের অবস্থানও একই জেলার আর এক প্রত্যন্ত এলাকায়। সদর থেকে সড়ক পথে যেতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। বাজারের আয়তন তেমন বড় না হলেও জনসমাগম লেগেই থাকে। কারণ আশপাশে দশ পনেরো মাইলের মধ্যে অন্য কোনো বাজার নেই। বাজারটি বিভিন্ন প্রকার ফল ও সবজিসহ নানা প্রজাতীর পাহাড়ি জুম চালের জন্য বিখ্যাত। হলুদ ও আদা ফুলের সালাদ স্থানীয়দের অত্যন্ত প্রিয় একটি খাবার। সেখানে দেখলাম, ছোট ছোট এক ধরনের হলুদ রংয়ের ফুল- নাম অগয্যা। ছড়ায় যে মাছ পাওয়া যায় তার সঙ্গে অগয্যা নাকি অসাধারণ। এ ছাড়াও তারাডাটা, বয়লা শাক, ইয়েরিং শাক, কয়দা, তিতগুলা, কলার মোচা বাজারের প্রধান পণ্য। চালের মধ্যে জুমে উৎপাদিত মাখাই, গ্যালন, রাংকুই ও চানালারী চাল বিকিকিনি হয় অধিক। অধিকন্তু বিন্নি চাল তো রয়েছেই। পিঠা-পুলি বানাতে সে চালের কদর তারা জানে।

0814326209381442395987

কৃষি কাজে পাহাড়িরা কোদাল বা লাঙ্গল ব্যবহার করে না। পাহাড়ের শরীরে ঢালু জুম ক্ষেত কর্ষণের একমাত্র সরঞ্জাম দা। দায়ের বিকল্প অন্য কোনো উপযোগী হাতিয়ার তারা আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। ঘর বাঁধা, গাছ কাটা, ফসল কাটা থেকে শুরু করে জমি কর্ষণ, নিরানী এমনকি তরকারি কাটাসহ সবকিছু ওই দায়ের সাহায্যেই করা হয়। হাত পায়ের মতোই দা যেন তাদের জীবন যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ- জানালেন জুমচাষী খামলাই বম। লক্ষ্য করে দেখলাম কথাটি বাড়িয়ে বলা নয়। স্বাভাবিক চলাফেরার সময়ও তারা সঙ্গে দা রাখে। ওই বাজারের কামারশালাতেও দেখলাম নানা আকৃতির দা তৈরি করে রাখা হয়েছে।

পাহাড়ে ফসল ও মালামাল বহনের একমাত্র সরঞ্জাম ঝুরি। যদিও ঝুরি তারা নিজেরাই বানিয়ে নেয়। তবুও কয়েক দোকানে স্তুপ করে রাখা ঝুরিও চোখে পড়ল। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ভারতের গোর্খা অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল এবং নেপালের পার্বত্য অঞ্চলে ব্যবহৃত ঝুরির তুলনায় বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার ঝুরি বুননে ও মানে অনেক বেশি শৈল্পিক এবং মজবুত।

বাংলাদেশে উৎপন্ন একমাত্র পাহাড়ি নদী সাঙ্গু। সাঙ্গুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বাজার। এর মধ্যে রেমাক্রি বাজার একটি। বান্দরবানের প্রত্যন্ত রেমাক্রি ইউনিয়নের সদর দপ্তরেই এই বাজার বসে। পাহাড়ে সমতল এলাকার মতো যত্রতত্র হাট-বাজার নেই। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভবও নয়। কথা হয় রেমাক্রি মৌজার হেডম্যান (পার্বত্য ভূমি ব্যবস্থায় মৌজা প্রধান) সাবলম বমের সাথে। তিনি জানান, বাজার জমে সপ্তাহে মাত্র একদিন। সেই একটি দিনের জন্য প্রতীক্ষা সকলের। কারণ শুধু বাজারই নয়, অঞ্চলের মানুষের কাছে এ যেন এক মিলনমেলা। দশ পনেরো কি.মি. পথ মাড়িয়ে অনেকে বাজারে আসে। বিশেষ করে লবণ এবং কেরসিন তেল কিনতে তাদের আসতেই হয়। কারণ জীবন ধারনের জন্য এই দুটি জিনিস ছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস তারা নিজেরাই উৎপাদন করে অথবা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে নেয়।

চার কোণাকৃতির রেমাক্রি বাজারের মাঝে রয়েছে একটি প্রাঙ্গণ। যেখানে ভলি ও ব্যাডমিন্টন খেলার কোট রয়েছে। বাজারের দোকানগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিটি দোকানের পেছনেই বাড়ি। বলা যায়, বাড়ির সামনের অংশটুকুই তারা দোকান হিসেবে ব্যবহার করে। ইদানিং আশপাশের দৃষ্টিনন্দন একাধিক জায়গাকে কেন্দ্র করে এলাকায় পর্যটন ব্যবসা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সুতরাং দোকানগুলোর পেছনের ঘরগুলোতে অনেকে পর্যটকদের থাকতে দেয়। এতে কিছু উপার্জনও হয় বটে! লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রায় শতভাগ দোকান বা ব্যবসা পরিচালনার ভার প্রধানত নারীদের ওপর। স্থানীয়দের উৎপাদিত কম্বল, পরিধেয় বস্ত্র এবং গামছা সেখানকার অন্যতম পণ্য। এ ছাড়াও পাহাড়ি জাতের মরিচ এবং আদার বড় এক অংশ আসে রেমাক্রি বাজার থেকে।

উল্লেখিত বাজারগুলোতে যত মানুষের সঙ্গে কথা হলো প্রায় সকলেরই মুখে একটিই কথা- পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। যে কারণে তারা চাইলেই সহজে বাজারে যেতে পারে না। ফলে সপ্তাহের ওই একটি দিনের অপেক্ষায় তাদের বাধ্য হয়ে থাকতে হয়।



মন্তব্য চালু নেই