‘অপকর্ম উন্মোচিত হওয়ার ভয়ে কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে সরকার’
ঢাকা: নিজেদের অন্যায়-অপকর্ম উন্মোচিত হওয়ার ভয়ে সরকার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, “এই গুম, অপহরণের হোতা অবৈধ সরকার মনে করেছে ২০ দলীয় জোটকে এই দিবসটি পালন করতে দিলে তাদের বিভৎস স্বরূপটি বিশ্ববাসীর কাছে আরো বেশি প্রকাশ হয়ে পড়বে।”
শনিবার সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল এসব কথা বলেন।
কর্মসূচি পালন করতে না দেয়ায় ফখরুল তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।২০ দলের আজকের নির্ধারিত মানববন্ধন কর্মসূচি আগামী ২ সেপ্টেম্বর পালন করা হবে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ফখরুল বলেন, সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আজ আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ৩০ আগস্ট গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ২০ দলীয় জোট এই দিবসটি পালনের জন্য মানববন্ধনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। মানববন্ধনের কর্মসূচি অত্যন্ত সুশৃক্সখল ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি। এই কর্মসূচি পালনের জন্য আমরা ঢাকা মহানগরী পুলিশ কমিশনারকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করি। প্রথমে আমরা প্রেস ক্লাবকে কেন্দ্র করে পূর্ব দিকে দৈনিক বাংলা মোড় এবং পশ্চিম দিকে শাহবাগ শিশুপার্ক পর্যন্ত মানববন্ধনের বিস্তৃতি উল্লেখ করে চিঠি দিই।
ফখরুল বলেন, কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচির অজুহাতে আমাদেরকে স্থান পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ করলে আমরা গতকাল নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে কেন্দ্র করে পূর্ব দিকে নটরডেম কলেজ এবং পশ্চিম দিকে বিজয়নগর মোড় পর্যন্ত মানববন্ধনের বিস্তৃতি উল্লেখ করে পূনরায় পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দিই। কিন্তু আজকের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ দি ভিকটিমস অব এনফোর্স ডিসএ্যাপিয়ারেন্স’ এর জন্য ২০ দলীয় জোটের মানববন্ধনের কর্মসূচিটিকে সফল করতে না দেয়ার জন্য তারা নানা ধরনের টালবাহানা করতে থাকে। গতকাল রাত দশটা-সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমরা বারবার তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সুস্পষ্টভাবে কিছু জানাননি। বারবার তারা প্রধানমন্ত্রীর জনসভার অজুহাত দেখান। রাত ১১টায় পুলিশ জানায় যে, আজ ৩০ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটি পালনের অনুমতি দেয়া হয়নি। ২০ দলীয় জোট পুলিশের এহেন অগণতন্ত্রিক আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, “এই দিবসটি পালনের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে গুমের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা। গুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানবাধিকার কর্মীরা এবং সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকরা সোচ্চার হয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের অবৈধ সরকার বিরুদ্ধ মত দমন, বিরোধী দল শূন্যকরণ এবং নাগরিক স্বাধীনতা হরণের জন্য রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের এক বিভৎস হাতিয়ার হিসেবে গুমকে অবলম্বন করছে।”
তিনি বলেন, “এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে গুম। অপহরণ ও গুপ্তহত্যার ব্যাপক বিস্তারে জনজীবনে নৈরাজ্যের অমানিষার মধ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম হচ্ছে এখন নিত্য দিনের সবচাইতে বড় ঘটনা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সালের ২৯ মে পর্যন্ত আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩৩০ ব্যক্তিকে গুম করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৫৭ জনের লাশ পাওয়া গেছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে ২৮ জনকে আইন শৃক্সখলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদেরকে গুম করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এইভাবে বাংলাদেশে বিদ্যমান গুম-খুনের ঘটনার যদি আমরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মানবাধিকার গ্র“পের তথ্য উত্থাপন করি তাহলে এক দীর্ঘ তালিকা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।”
ফখরুল বলেন, “আজকে আমরা তালিকা উপস্থাপনের জন্য আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখছি না। এ বিষয়ে আপনাদের সামনে অনেকবার কথা বলেছি। আমরা শুধু দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই, সরকার নিজের অপরাধ, অপকর্ম উন্মোচিত হওয়ার ভয় থেকেই ২০ দলীয় জোটকে এই আন্তর্জাতিক দিবসটি পালন করতে দেয়নি। এই গুম, অপহরণের হোতা অবৈধ সরকার মনে করেছে ২০ দলীয় জোটকে এই দিবসটি পালন করতে দিলে তাদের বিভৎস স্বরূপটি বিশ্ববাসীর কাছে আরো বেশি প্রকাশ হয়ে পড়বে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের পুলিশের এখন একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা দেয়া। ক্ষমতাসীন দলের প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে কাজ করছে বলেই প্রধানমন্ত্রীর মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে পুলিশের আচরণে। বৃহৎ ঢাকা মহানগরীতে শাসক দলের কর্মসূচি চললে আর অন্য কোনো দল নিজেদের কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারবে না এটাই হচ্ছে এখন রীতি। দলীয় লোকদের দিয়ে সাজানোর কারণেণই আইন শৃক্সখলা বাহিনী শাসকদলের অনুরাগী অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে বলেই আইনের শাসন ধসে গিয়ে দেশে এখন আওয়ামী শাসনের বন্য উৎসব চলছে।”
তিনি বলেন, “গুম মৌলিক মানবাধিকারের চরম লক্সঘন। এই কর্মসূচিটি তারা ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে অত্যন্ত তৎপরতার সাথে চালিয়ে এসেছে নিজেদের অবৈধ অস্তিত্বকে নিরাপদ করার জন্য। কারণ বিরোধী দলসহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার নাগরিকবৃন্দকে অদৃশ্য করতে পারলেই তারা সারাদেশের ওপর দখলবাজি বজায় রাখতে পারবে। সরকার গুমজনিত অপরাধ তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করে, যাদেরকে সরকার শত্রু হিসেবে গণ্য করে।”
সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল বলেন, “গুম হওয়া ব্যক্তিদের যেহেতু কোনো হদিস থাকেনা সেহেতু তারা কী অধিকার ভোগ করেন সেটি কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। হয়তো তারা ভয়ঙ্কর নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হন, সবসময় মৃত্যুভয়ে থাকেন কিংবা তারা হত্যারও শিকার হন। অথচ আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকেন। গুম হওয়া ব্যক্তিকে যদি মেরে ফেলা হয়, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানও পালন করা যায় না। কারণ তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া যায় না। গুম হওয়া অনেক পরিবারের সদস্যরা আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার তো দূরে থাক বরং গুম হওয়া ব্যক্তিকে তারা যে আটক করেছে তা স্বীকার করে না। এখন ভুক্তভোগী অনেক পরিবারই আইন শৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কোনো অভিযোগ করে না। গুম হওয়া পরিবারগুলোর অবিরাম কান্না চলছেই। কারণ গুম হওয়া ব্যক্তিরা বেঁচে আছে না মারা গেছে সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নয়।”
তিনি বলেন, “এই অবৈধ সরকার গণতন্ত্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে আত্মসাৎ করেছে। এরা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে গুম করার পাশাপাশি ভোট, পার্লামেন্ট, আইনের শাসন এবং শেষমেষ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেও গুম করেছে। যারা রক্তপাতকেই রাজনীতির ইস্তেহার বানিয়েছেন তাদের কাছে শান্তির ললিতবাণী শুনিয়ে কোনো লাভ হবেনা। এরা জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা সামাল দিতেই হত্যা ও গুমকেই একমাত্র সমাধান বলে মনে করছে। ফ্যাসিবাদকে প্রলম্বিত করার জন্যই এরা গুমের কোনো বিকল্প দেখছে না। সুতরাং সেইজন্যই গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত উপাদান মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা এবং মানবসাম্যকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রশক্তিকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদকে স্থিতিশীল রাখতে চায়। আর এজন্যই তাদের গুম, গুপ্তহত্যা, বে আইনী অপহরণ, কটুক্তি, অশ্রাব্য গালিগালাজ, পেশী প্রদর্শন অত্যন্ত জরুরি।”
ফখরুল বলেন, “কোনো পাশবিক স্বৈরাচার চিরদিন একটানা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। যারা নিজেদের জেদ ও স্বার্থপরতার জন্য জনগণকে যারা নিপীড়ন করে তাদের পরিণতি ইতিহাসে জাজ্বল্যমান। কোনো স্বৈরাচারই নিজেদের অবাধ অপকর্ম অব্যাহত রাখতে পারেনি। সময়ের নির্মমতা ও প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে তারা কখনোই রেহাই পায়নি।”
ফখরুল জানান, আগামীকাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। সেইজন্য আজকের আন্তর্জাতিক গুম দিবসে ২০ দলীয় জোটের ঢাকা মহানগরীর মানববন্ধনের কর্মসূচিটি আগামী ২ সেপ্টেম্বর ২০১৪, মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী সময়ে মানবন্ধন কর্মসূচিটির সময় ও স্থান জানিয়ে দেয়া হবে।
মন্তব্য চালু নেই