আমি আইজিপি বলছি, আসামিকে এখনই ছেড়ে দেন
আমি আইজিপি বলছি। কাল যে ওয়ারেন্টের আসামিকে ধরেছেন তাকে এখনই ছেড়ে দেন। এক সেকেন্ডও দেরি করবেন না। এটা আমার আদেশ। ১০ মিনিটে আদেশ পালন না হলে আপনি সাসপেন্ড। ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের এক ওসির নম্বরে ফোন করে আইজি পরিচয়ে এ আদেশ দেয়া হয়। আদেশটি উদ্ভট হলেও নম্বরটি সত্যিই ছিল পুলিশের আইজির সরকারি মোবাইল ফোন নম্বর। তাই ওসিও কালবিলম্ব না করে আসামি ছেড়ে দেন। দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকে এমনই এক অনুসন্ধান মূলক প্রতিবদেন প্রকাশ হয়েছে।
জানা গেছে, ওই আসামি ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ফেরার ছিলেন। পুলিশ বহুকষ্টে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আইজিপির ফোনে থানা পুলিশের সব পরিশ্রম পণ্ড হয়। হাজত থেকে বেরিয়েই আসামি লাপাত্তা হয়ে যান। ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বিষয়টি তার এক ঊর্ধ্বতন অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করেন। অফিসার তাকে বলেন, আইজি স্যার তো এভাবে ফোন করার কথা নয়। এরপরই তদন্ত শুরু হয়। জানা যায়, ঘটনাটি ছিল স্রেফ একটি প্রতারণা। প্রযুক্তির সহায়তায় করা এ প্রতারণার শিকার হয়েছেন খোদ থানা পুলিশের ওসি।
কিন্তু মোবাইল নম্বরটি তো আসল। প্রশ্ন হল, সেটি কীভাবে সম্ভব? অবিশ্বাস্য এ ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসে গা শিউরে ওঠার মতো আসল তথ্য। দেখা গেছে, ইন্টারনেটে এক ধরনের বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে আইজিপির নম্বর থেকে ফোন করা হয়। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে কারও নম্বর থেকেই ফোন করা সম্ভব। এ সফটওয়্যারটির নাম স্পুফিং। এটিকে ইন্টারনেট ডায়ালারও বলা হয়।
তবে ঘটনার এখানেই শেষ নয়। গত মাসে টাঙ্গাইল-৬ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার আবদুল বাতেনের মোবাইল ফোন নম্বর থেকে স্থানীয় নাগরপুর ও দেলদুয়ারের সব ইউপি চেয়ারম্যানকে ফোন করা হয়। ফোনকারী সবাইকেই অভিন্ন ভাষায় বলেন, এটি এমপি সাহেবের নম্বর। তিনি এখন সচিবালয়ে আমার কক্ষে বসা আছেন। আমি উনার ফোন থেকে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বলছি। আপনার ইউনিয়ন পরিষদের নামে শিগগিরই গম বরাদ্দ দেয়া হবে। বেশি বরাদ্দ পেতে হলে কিছু টাকা বিকাশ করে দেন। চেয়ারম্যানদের কাউকে কাউকে আবদুল বাতেনের ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়েও টাকা চাওয়া হয়। টাকা পাঠানোর জন্য একটি বিকাশ নম্বর দিয়ে বলা হয়, এখনই টাকা বিকাশ করে দেন। এমপির নম্বর থেকে ফোন পাওয়ার পর প্রায় সব ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশে তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কেউ ১০ হাজার, কেউ আবার ২০ হাজার করে টাকা বিকাশ করেন।
কিন্তু মাস পেরিয়ে গেলেও বরাদ্দ না পেয়ে তারা এক মিটিংয়ে এমপির কাছে বিষয়টি তুলে ধরে বিলম্বের কারণ জানতে চান। ঘটনা শুনে তো এমপি হতবাক। তিনি বলেন, আপনারা কি মশকরা করছেন? এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তার নম্বর থেকে কোনো উপসচিব কিংবা তার পিএ ফোনই করেননি। এরপর সবার চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা। কিন্তু এত বড় বাস্তব ঘটনাকে কেউ অস্বীকার কিংবা ভুলও বলতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন, এটা জিন-পরির কাণ্ড-কারখানা নাকি? কিন্তু না, তা হবে কেন? ফোন রিসিভ করার সময় তো এমডি সাহেবের নামে সেভ করা নম্বরই তারা দেখেছেন। এমপির নম্বর দেখে তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভও করেছেন। মোটকথা, এ বিষয়টি অস্বীকার করার পর উপস্থিত প্রত্যেকে ভিন্ন এক রহসের্য মধ্যে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন। কিন্তু এ প্রযুক্তির যুগে বিষয়টি কেউ সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ। মামলা করা হয় দেলদুয়ার থানায়। শুরু হয় তদন্ত। এরপর রহস্যের জট খুলতে শুরু করে।
ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, একটি চক্র ইন্টারনেট থেকে বিনামূল্যে পাওয়া একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে এ কাজটি করেছে। তদন্তের সময় এ ধরনের আরও ৬টি প্রতারণার ঘটনা জানা যায়। তদন্তসংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তারা দেখতে পান এমপির নম্বর ব্যবহার করে ফোন করার পর একটিমাত্র বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে প্রতারকরা দেলদুয়ার ও নাগরপুরের ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মামলা হওয়ার পর তদন্তের সময় টাকা প্রেরণকারী ইউপি চেয়ারম্যানদের মোবাইল ফোনের কল লিস্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, সত্যিই এমপির মোবাইল নম্বর থেকে ইউপি চেয়ারম্যানদের ফোন করা হয়েছে। ফোনকলে (ইনকামিং) তার সুনির্দিষ্ট রেকর্ডও রয়েছে। কিন্তু তদন্তকারী দলটি এমপির মোবাইল ফোনের কললিস্ট তুলে দেখতে পান সেখানে ফোন করার (আউটগোয়িং) কোনো রেকর্ড নেই। প্রকৃতপক্ষে তখনই প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, এ ঘটনায় ১৩ জুন দেলদুয়ার থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এ মামলাটি করেন দেলদুয়ার ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম। চাঞ্চল্যকর মামলাটির ছায়া তদন্ত করছে পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে দেলদুয়ার থানার ওসি মোশারফ হোসেন সোমবার বলেন, মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। ঢাকা থেকে মামলাটির তদারক করা হচ্ছে। যে কোনো দিন আসামিদের গ্রেফতার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হবে। যুগান্তর
মন্তব্য চালু নেই