২০২৫ সালের অাগে জানা যাবে না হিলারি-ইউনূস ইমেইলের অনেক তথ্য

বয়স পেরিয়ে গেলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকতে পারেন সেজন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সবরকম চেষ্টা চালিয়েছিলেন হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে জটিলতার উত্তরণ এবং ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকতে পুরনো বন্ধু হিলারির দ্বারস্থ হলে হিলারি ক্লিনটন তার অবস্থান থেকে শেষ পর্যন্ত নিস্ফল চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

বিতর্কের মুখে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের যে সাত হাজার ই-মেইল প্রকাশ করেছে তার বেশকিছুই ড. ইউনূস এবং বাংলাদেশ সংক্রান্ত। তবে কিছু মেইলে হিলারি যা লিখেছিলেন সেগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। ক্লাসিফাইড নথি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে ২০২৫ সালে ওই মেইলগুলো প্রকাশ করার আগে সেখানে কি লেখা আছে তা জানা যাবে না।

হিলারি ক্লিনটনের প্রকাশিত সাত হাজার মেইলের মধ্যে ৩১৭টি মেইলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। তার বেশ কয়েকটিতেই আছে গ্রামীণ ব্যাংকের কথা।

কিছুক্ষেত্রে যে আইডি থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মেইল পাঠানো হয়েছে, ক্লাসিফাইড হিসেবে তাদের পরিচয় মুছে দেওয়া হয়েছে। তবে একাধিক মেইলে উল্লেখ আছে যে ওই মেইলগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে পাঠানো হচ্ছে, অথবা ওই মেইলগুলো গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত।

গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে মেইল চালাচালি শুরু হয় ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর।

ইউনূসের কিছু মেইল সরাসরি হিলারি ক্লিনটনকে না পাঠিয়ে মেলানি নামের একজন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। তিনি পরে সেগুলো হিলারি ক্লিনটনের কাছে ফরোয়ার্ড করেছেন।

ড. উইনূসের মেইলের সঙ্গে সম্পর্কিত মেলানির নাম প্রকাশ করা হলেও এক বা একাধিক ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়নি যারা ইউনূসের বার্তা হিলারির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন অথবা ইউনূসের জন্য হিলারির কাছ থেকে বার্তা পেয়েছেন।

একটি মেইলে দেখা যায়, ‘ইউনূস এখনো তার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী’ উল্লেখ করে হিলারি ক্লিনটনকে একটি বার্তা ফরোওয়ার্ড করেন মেলানি।

মূল মেইলে প্রেরকের ঠিকানার অংশটি সাদা করে দেওয়া হলেও পাশেই লিখা ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হয়ে এই ই-মেইল পাঠানো’। ই-মেইলটির বিষয় হিসেবে লেখা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা।

মেইলটি এরকম:
প্রিয় মেলানি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। জাতিসংঘের অ্যাসেম্বলি মিটিংয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদের আমেরিকা ভ্রমণের ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনি সেক্রেটারি ক্লিনটনকে ফোন করবেন ১৬ সেপ্টেম্বর। সেখানেই যদি সম্ভব হয় তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকর বিষয়টা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে তুলবেন। দয়া করে চেষ্টা করবেন গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টা নিয়ে একটু কথা বলতে।

আমরা বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পরামর্শে আমাদের সমস্যাগুলো জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটা বৈঠকের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রায় ছয় মাস হতে চললো, সেখান থেকে কোনো জবাব পাইনি।

দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আমাকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম পাওয়ার জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এখনো একটি শব্দও বলেননি। আপনি নিশ্চয়ই সমস্যার গভীরতা টের পাচ্ছেন।

আমি আশা করি আপনাকে বিস্তারিত বোঝাতে পেরেছি। আর কি করা উচিত হবে সেটাও বোঝাতে পেরেছি। ধন্যবাদ সহযোগিতার জন্য। এইচকে (হিলারি ক্লিনটন)-কে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন। সিজিআই এবং হিলটন নিয়ে দ্রুতই দেখা হবে।
ইউনূস।

3TC1nDiNAvSI

২০০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মেলানিকে পাঠানো আর একটি মেইল রয়েছে সেখানে। তাতে ওই দিনই বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ‘Prime Minister Hasina Warns’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে হিলারির উদ্দেশে ইউনূস লিখেন: বাংলাদেশের দৈনিকটিতে প্রকাশিত খবরটি দেখবেন। পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন সেটা নিয়েই খবরটি। হাইলাইট করা অংশটিতে প্রধানমন্ত্রী মূলতঃ আমাকেই বুঝিয়েছেন, সরাসরি নামে নয়, বর্ণনায়। যদি পারেন আমার সম্পর্কে তার ভয়াবহ মনোভাব দূর করার একটি পথ খুঁজে বের করুন। আপনাকে শান্তির দূত হবার আহবান জানাচ্ছি। তা না হলে কোনো কারণ ছাড়াই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। প্রধানমন্ত্রী জেনারেল অ্যাসেম্বলি মিটিংয়ের জন্য নিউইয়র্ক যাবেন। সেখানেই হয়তো সেক্রেটারী হিলারির সঙ্গে দেখা হবে।

মেইলটি মেলানি হিলারিকে ফরোয়ার্ড করেন, ‘হাসিনা ও ইউনূসের চলমান কাহিনী’ লিখে। সেখানে মেলানি যোগ করেন, ইউনূসের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সবকিছুই কঠিন করে তুলছেন। স্বাস্থ্য কার্যক্রম নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা আপনার সঙ্গে তার হয়েছিলো সেটাতে সরকার রাজি হয়নি। ইউনূসের আশা এমন কোনো পথ নিশ্চয়ই আছে যেটা দিয়ে তাকে নিশ্চিত করানো যাবে যে ইউনূস রাজনীতিতে আগ্রহী নন মোটেও এবং দেশকে একটি আদর্শ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে প্রধানমন্ত্রী ইউনূসকে ব্যবহার করতে পারেন। কিছু ব্যক্তিগত বিরোধও আছে যেটার গভীরতা ইউনূস পরিমাপ করতে পারছেন না। অগ্রগতি খুবই খারাপ।

জবাবে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১০ এ হিলারি লিখেন: আগামীকাল ইউনূসের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ‍দুজনেই হিলটন ফাউন্ডেশন নিয়ে কথা বলতে চাই। সেখানেও আরো বেশি কিছু জানতে পারবো।

২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর আরেকটি মেইল পাঠানো হয় মেলাননিকে। এতেও প্রেরকের অংশটি সাদা রাখা হয়। মেইলের বেশ কিছু অংশ মুছে প্রকাশ করা হেয়েছে। তবে নিচে একটি নোটে পুরোপুরি প্রকাশ করা হয় ইউনূসের পরিস্থিতি। বিষয় হিসেবে লেখা হয়, যখন আমরা ভাবছিলাম সবকিছু শান্ত হয়ে গেছে।

ইমেইলের একেবারে নিচে যোগ করা একটি নোটে লেখা: প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, নোবেল বিজয়ী ইউনূসের বিরুদ্ধে বিদেশী সাহায্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অন্য কোম্পানিতে পাঠানোর যে অভিযোগ সেসব পুনরায় তদন্ত করা হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক উদাহরণ তৈরি করেছে। টাকা আত্নসাৎ করে ধোঁকা দেওয়াটাও একটা উদাহরণ। এসব আর কিছুই না, টাকা দিয়ে জনগণের টাকা নিয়ে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া মাত্র। দরিদ্রদের জীবনে এতে কোনোই উন্নতি আসেনি। বরং তারা শুধু আরো বেশি বিদেশী সাহায্য পাওয়ার দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।’

শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে মেইলে বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ গিনিপিগ হয়েছে, আমি কখনো এটা সমর্থন করিনি আর এখন প্রতিবাদ করছি।

2

মেইলে বলা হয়: দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, আগে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের অংশ ছিলো ৬০ শতাংশ, এখন সেটা মাত্র ২৫ শতাংশ। মনে হয় মি. ইউনূস সরকারের তহবিল সম্ভব হলে পুরোই খালি করে দিতে চান। কিন্তু সরকার সেটা হতে দিতে চায় না।

ওই মেইলটিতে বলা হয়, তিনি জানতে চেয়েছিলেন সরকার ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য আবার তদন্ত পরিচালনা করবেন কিনা? প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘গ্রামীণ ব্যাংককে এমন করে ধরে রাখা হয়েছে যেনো সেটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সেটারও তদন্ত হবে। গরীবরা এখানে শিকার হচ্ছেন। তাদের মিষ্টি কথায় ভোলানো হচ্ছে। অবশেষে সবই সামনে আসছে।

বলা হয়: শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি ইউনূসের আকর্ষণকে তার ক্যান্টনমেন্ট বাড়ির প্রতি খালেদা জিয়ার আকর্ষণের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংক জনগণের সম্পত্তি। ভালোবাসার বাইরে সেটা বেসরকারিকরণ হয়েছে। ইউনূস সাহেব গ্রামীণ ব্যাংকের প্রেমে পড়েছেন। গরীবের টাকা নিয়ে কেউ খেলতে পারে না।’

নরওয়ের ন্যাশনাল টিভি এনআরকে ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর ‘কট ইন মাইক্রোক্রেডিট’ নামে যে প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে আর এর ভিত্তিতে বিডিনিউজ২৪.কম যে খবর প্রচার করে তাও উঠে এসেছে হিলারির মেইল চালাচালিতে।

তাকে জানানো হয়, ডকুমেন্টারি মতে ইউনূস টাকা গ্রামীন কল্যাণে ট্রান্সফার করেছেন যেটা কিনা কোনোমতেই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলো না।

আর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংক যে কথা বলেছে তাও হিলারিকে জানানো হয়। এতে গ্রামীণের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ কল্যাণের মধ্যে কোনো ভুল চুক্তি নেই। সেই ভিত্তিতেই ব্যাংক থেকে ৩,৯১৭ মিলিয়ন টাকা প্রদান করা হয়। ‘সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকের বোর্ড। ধীরতার সঙ্গে, বিশ্বাসের সঙ্গে এবং ভালো উদ্দেশ্যেই গরীবদের সাহায্য করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়’ বলে জানায় গ্রামীণ ব্যাংক।

আর একটি মেইলে দেখা যায় ৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে নরওয়েন এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের দেওয়া একটি বিবৃতি সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। সেই বিবৃতিতেও গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ কল্যাণে ট্রান্সফারের সমালোচনা করা হয়। এটাকে দুর্নীতিপ্রবণ কর্মকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই মেইলটিতেও প্রেরকের অংশটি সাদা রাখা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই