পানিবন্দি লাখো মানুষ : সম্পদ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি,খাদ্য ও ঔষধ সঙ্কট

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ও প্রবণ বর্ষণের ফলে নওগাঁর রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী ফুলবাড়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ, উপজেলার মিরাপুর নামক স্থানে নওগাঁ-আত্রাই আঞ্চালিক সড়কের বাঁধ, ভরতেঁতুলিয়া বেড়িবাঁধ ও হাটকালুপাড়া বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে আত্রাই ও রাণীনগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি।

বন্যা কবলিত মানুষেরা বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় এর্ব উঁচুস্থানে গবাদি পশুসহ আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন করছেন । রোগবালায় বৃদ্ধি পেয়েছে, খাবার ও ওষুধ সংকটে বানভাসী মানুষেরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠায় আত্রাই উপজেলায় ৪০টি এবং রাণীনগর উপজেলার ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করেছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আত্রাই উপজেলার বন্যার্ত মানুষের মাঝে জিআর ৪৫ মেঃটন চাল ও ৬৫ হাজার টাকা এবং রাণীনগর উপজেলায় ৪০ মেঃটন চাল নগদ ৫৩ হাজার টাকা বিতরণ করেছেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বানভাসী মানুষেরা।

এ ছাড়াও বৃহস্পতিবার নওগাঁ জেলা প্রশাসক ড. আমিনুর রহমান দুটি উপজেলার বন্যা কবলিত বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন করেছেন এবং কয়েকটি স্থানে বানভাসী মানুষ, সরকারী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মত বিনিময় সভা করেছেন এবং নৌকা নিয়ে বন্যাকবলিত বিভিন্ন গ্রামে মানুষদের সান্তনা দেন। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা অব্যহত থাকবে।

সেই সাথে স্থানীয়ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।তিনি বানভাসী মানুষের পর্যাপ্ত ত্রাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখেছেন তা আসলেই বিতরণ করা হবে। তিনি সকলকে ধৈর্যের সাথে এই বিপদ মোকাবেলা করার জন্য আহবান জানান।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন,সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নকিবুল বারী, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা ইউনুস আলী, আত্রাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এবাদুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্রান একরামুল বারী, রঞ্জু ও মমতাজ বেগম, রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনিরুল ইসলাম পাটওয়ারী, আত্রাই থানার ওসি আব্দুল লতিফ খান, শাহাগোলা ইউপি চেয়ারম্যান এসএম মোয়াজ্জেম হোসেন চাঁন্দু। ভোপারা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল চকলেট, হাটকালুপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক দুলুসহ অন্যান্য ইউপি চেয়ারম্যানবৃন্দ।

ভাঙ্গা স্থান আরও বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় তিন শত ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সড়ক ও জনপথ বালির বস্তা দিয়ে নতুন করে ভাঙ্গল ঠেকানোর চেষ্টা করেও পানির তীব্র স্রোতে ভাঙ্গন ঠেকাতে পারেনি।

পানি বন্দী হয়ে পড়েছে দুই উপজেলার ১০ ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষ। পানির স্রোতে শত শত কাঁচাবাড়ি ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে কয়েক হাজার বিঘা জমির রোপা-আমন ধান ও শাক-সবজি নতুন করে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শত শত পুকুরের মাছ ভেসে যাচ্ছে। কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। জেলা শহরের সাথে আত্রাই উপজেলাসহ নাটোরের সাথে সড়ক যোগাযোগ এখনও সম্পূন্ন বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যায় বিদ্যুতের খুটি উপড়ে যাওয়ায় অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যার্ত মানুষগুলো গরু বাছুরসহ অন্যান্য বাঁধে বা উঁচু স্থানে , বাড়ির ছাদে,খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাবন করছে।

বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট রয়েছে। ছোট যমুনা নদী তীরবর্তী ফুলবাড়িয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়ী বাঁধ ভেঙ্গে ফুলবাড়িয়ার রাসেল,রেজা উজ্জলসহ ৩০ পরিবারের পাকা বাড়িঘর পানির স্রোতে বিলিন হয়ে গেছে। ওই পরিবারগুলো ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন দিশেহারা হয়ে অন্যেরবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছে।

রাসেল জানান, ৩ বছর আগে ৮ লাখ টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করে মাঠি কেটে পাকা বাড়িঘর নির্মাণ করতে প্রায় ১১ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। ফুলবাড়ি বাঁধ ভাঙ্গায় আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেলাম।আমার সামনে এখন অন্ধকার দেখছি। আমি এখনও কোন ত্রান সামগ্রী বা কোন তালিকায় নাম উঠেনি বা পায়নি বলে জানান তিনি। আরও ২০-২৫টি পরিবারের ঘড়বাড়ি বিলিন হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই বেশি রয়েছে।

মিরাপুর নামক স্থানে নওগাঁ আত্রাই আঞ্চলিক সড়কের ভাঙ্গা স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ করায় বিস্তীর্ন এলাকায় প্লাবিত হয়ে দিন দিন পানি বৃদ্ধিই পাচ্ছে। দুটি উপজেলার ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠায় বিদ্যালয় খোলা থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীরা আসছেনা। এ বিষয়ে আত্রাই উপজেলা শিক্ষা অফিসার সাফিয়া আক্তার অপু জানান, আত্রাইয়ে গত কয়েক দিন বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় এবং বিদ্যালয়গুলোতে বন্যার পানি প্রবেশ করায় উপজেলার বেওলাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পারমোহনঘোষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাশিয়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্বমিরাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বলরামচক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নন্দনালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আত্রাই আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।
অপর দিকে উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানাযায়, বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় উপজেলার কাশিয়াবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়, শলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, জগদাশ উচ্চ বিদ্যালয়, বড় কালিকাপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা, তারাটিয়া মাষ্টার মাইন্ড বিএম কলেজ, উদনপৈ দাখিল মাদ্রাসা, ও আটগ্রাম দাখিল মাদ্রাসাসহ ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।

এদিকে উপজেলার শাহাগোলা দারুস সুন্নাহ কওমী মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মাও. ইদ্রিস আলী জানান, প্রবল বন্যার পানি মাদ্রাসার কক্ষগুলোতে ঢুকে যাওয়ায় এবং পানিবন্দী হয়ে পড়ায় মাদ্রাসাটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নীচে গবাদী পশুসহ মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

বন্যার পানিতে মানুষ বেরুতে না পেরে দারুন কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। যমুনা ও আত্রাই নদীর পানি কমলেও বৃহস্পতিবার থেকে পুনুরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ও ছোট যমুনা নদীর পানি পিবদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার্ত এলাকায় রোগবালায় বৃদ্ধি পেয়েছে। খাবার ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

শাহাগোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, উপজেলার ৮ টি ইউনিয়নের মধ্যে শাহাগোলা ইউনিয়নের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এদর মধ্যে ফুলবাড়ি, উদপৈয়, মিরাপুর, তারাটিয়া, আকবরপুর গ্রামে বেশি ক্ষতি হয়েছে। পাকা বাড়িঘর বিলিন হয়ে গেছে। এ ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ত্রাণ সামগ্রী যা পেয়েছি তা তুলনায় খুবই কম। তবে তিনি রবি শস্য না উঠা পর্যন্ত আরও বেশি করে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়ার জন্য সরকারের আবেদন জানান।



মন্তব্য চালু নেই